স্বপরিচয়েই ভোটার হতে পারবেন হিজড়ারা
২৭ জুলাই ২০১৮২০১৩ সালে হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া সংক্রান্ত নীতিমালা মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পায়৷ ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার৷ তবে এতদিন আইনি জটিলতায় আটকে ছিল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পরিচয়৷ সম্প্রতি ভোটার তালিকায় নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আরেকটি পরিচয় অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আব্দুল বাতেন ডয়চে ভেলেকে জানান, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারবেন৷ নারী ও পুরুষের পাশাপাশি নিবন্ধন ফরমে তৃতীয় লিঙ্গদের জন্যও আলাদা আরেকটি পরিচয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে৷ একই ধারাবাহিকতায় তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডটি তাদের নিজস্ব পরিচয় বহন করবে৷ এ বিষয়ে কমিশনের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে বলেও জানান তিনি৷
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তাঁরা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোট দিতে পারবেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুল বাতেন জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর যেহেতু খুব বেশি দেরি নেই, এর মধ্যে কেবল যারা নির্বাচন অফিসে এসে নতুন করে নিজেদের তালিকাভুক্ত করতে চাইবেন তাঁদের নামই সংযোজন বা সংশোধন করা হবে৷ পরবর্তীতে এ চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা নিজেদের পরিচয়েই দেশের নাগরিক হিসেবে নথিভুক্ত হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি৷
২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের নাদিরা খানম রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হন৷ তবে পরিচয় হিসেবে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল ‘নারী' পরিচয়৷ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার হতে পারার এ সংবাদকে স্বাগত জানিয়ে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের স্বীকৃতি জানিয়েছে৷
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ৷ তবে এখনো সে আইন বাস্তবায়ন হয়নি৷ পরিচয় নিশ্চিত করা গেলে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে৷'' আইন না থাকায় ‘নারী' হিসেবে ভোটার হতে বাধ্য হন নাদিরা এবং এই পরিচয়েই প্রার্থী হন তিনি৷ পরিচয়পত্রে নিজস্ব পরিচয় দেবার সুযোগ থাকলে আরো অনেক দেশের মতোই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা নিজস্বতা নিয়ে ভোটের মাঠে আসতে পারবে, যা সার্বিকভাবে এ জনগোষ্ঠীর মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি৷
প্রয়োজন প্রচার
তৃতীয় লিঙ্গের সংগঠন ‘সাদাকালো'-র প্রেসিডেন্ট অনন্যা বণিক বলেন, এ উদ্যোগ প্রশসংনীয় হলেও এর সাফল্য নির্ভর করছে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার উপর৷ সমস্যাগুলো কী তা চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে না এগুলে কাগজে কলমে যা কিছু হোক, তাতে খুব বেশি লাভ হবে না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমার বয়স ৪৩, আমার গুরুর বয়স ৬৩৷ এখন যদি সরকারকে গিয়ে বলি আমি স্মার্ট কার্ড বদলাতে চাই, জন্ম নিবন্ধন বদলাতে চাই, সার্টিফিকেট বদলাতে চাই, তাহলে তা কখনোই হবে না৷ যারা নতুন ভোটার হবেন, তাদের জন্য এটা কাজ করতে পারে৷ তবে তাদের সংখ্যা আসলে কত বা আদৌ তারা তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় দিতে কতটা চাইবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের কাছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য নেই৷ এই যে উদ্যোগ নেয়া হলো সে বিষয়ে যথাযথ প্রচারণাও নেই৷ আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধন, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমি নারী হিসেবে আছি৷ আমি তো জানি না যে, আমি কোত্থেকে শুরু করবো৷'' তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য এই যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, এটি সবক্ষেত্রে একাধারে হতে হবে উল্লেখ করে ডয়চে ভেলেকে অনন্যা বলেন, ‘‘যাদের জন্য পরিবর্তনটা হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে হবে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত হিজড়াদের কাছে খবরটা না পৌঁছাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা হিজড়ারা কী করে জানবো, কী করে পরিবর্তন করবো? এবং খবরটা পৌঁছানোর পর আমরা যখন সব জায়গায় যাবো সে দাবি নিয়ে, তখন যেন আমাদের পরিবর্তন করার জন্য সহায়তা করা হয় এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালমা আক্তারও মনে করেন যাদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, প্রয়োজন রয়েছে এ পলিসির অধীনে তাঁরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন সে বিষয়ে তাদের পরিষ্কার বার্তা দেয়া৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এতদিন তাদের কোনো আইডেন্টিটি ছিল না৷ এ পলিসিটা হলে তাদের নিশ্চয় এ ক্রাইসিস থেকে মুক্তি দেবে৷ কিন্ত তাদের অধিকারগুলো, সংবিধান যে অধিকারগুলো দেশের মানুষদের দিয়েছে সেগুলো তাঁরা পাবেন কিনা, সে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে আসা দরকার৷'' তবে তিনি মনে করেন সরকারিভাবে এ স্বীকৃতি তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে একটি জোরালো পদক্ষেপ হতে পারে৷ সরকারের এ পদক্ষেপ যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে যে অধিকার থেকে তাঁরা এতদিন বঞ্চিত ছিলেন, সেগুলো তাঁদের জন্য নিশ্চিত করার কাজ শুরু হতে পারে৷ সালমা আক্তার বলেন, ‘‘এ পদক্ষেপ সমস্যা সমাধানের কেবল শুরু, শেষ নয়৷ এখান থেকেই স্বীকৃতিটা শুরু হলো৷ সামাজিক সচেতনতা আনতে এ বিষয়ে আরো বেশি কাজ করতে হবে৷''
এ নিয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷