সৌরভকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করে বিপাকে পড়েছিল সংস্থা
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১খুবই বিপাকে পড়ে গিয়েছিল আদানি উইলমার। তদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফরচুন রাইস ব্র্যান অয়েলের ঢালাও বিজ্ঞাপন করেছেন তিনি। এই তেল দিয়ে রান্না করলে নাকি হার্ট ভালো থাকে। তা সেই সৌরভই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তারপর তার বুকে স্টেন্ট লাগানো হলো। সামাজিক মাধ্যমে সৌরভের আরোগ্য কামনায় প্রার্থনার পাশাপাশি সাবেক ভারতীয় ক্যাপ্টেন যে তেলের বিজ্ঞাপন করছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, হার্ট ভালো থাকে, আর যিনি বলছেন, তিনিই হৃদরোগে আক্রান্ত। তাহলে?
এই মহাবিপদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে কোম্পানি তড়িঘড়ি করে সেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিলো। আর সেই সঙ্গে বিবৃতি। আদানি উইলমারের চিফ এক্জিকিউটিভের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ''এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতেই পারে। রাইস ব্র্যান অয়েল কোনো ওষুধ নয়। এটা শুধুমাত্র ভোজ্য তেল। হৃদরোগের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করে, যেমন খাবারের অভ্যাস, বংশগত বিষয়, ইত্যাদি।'' বিবৃতিতে জানিয়ে দেয়া হয়, সৌরভ তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডার থাকবেন। তিনি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন। পরে সৌরভের সঙ্গে বসে বিষয়টি ঠিক করা হবে।
ঘটনা হলো, এরপর সোয়া চাঙ্ক ইত্যাদির বিজ্ঞাপনে সৌরভকে দেখা গেলেও ভোজ্য তেলের বিজ্ঞাপনে তিনি আর নেই। সেলিব্রিটিকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করানো যে লাভের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমজনতা, বিশেষ করে তার গুণমুগ্ধরা সহজেই সেই বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হন এবং প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে শুরু করেন। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার এত বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গে সৌরভের থেকে বড় আইকন পাওয়া ভার। তাই বাংলার ‘দাদা'কে নেয়া অবশ্যই লাভজনক। কিন্তু আদানি উইলমারের দুর্ভাগ্য যে, তাদের রাইস ব্র্যান অয়েল নিয়ে সৌরভের দাদাগিরি বেশদিন চলেনি। বরং এই অভাবিত কাণ্ডে তারা বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। এরপর বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সংস্লিষ্ট সংস্থা, সেলিব্রিটি-- কার দায় কতটা সেই প্রশ্ন উঠবেই।
এমনিতে ক্রিকেটাররা, বিশেষ করে শচিন টেন্ডুলকারের মতো তারকা ক্রিকেটাররা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকেন। কোনোরকম বিতর্ক যাতে না হয়, তাদের বিজ্ঞাপনের কোনো কুপ্রভাব যাতে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে বা যুবসমাজের উপর না পড়ে সে বিষয়টি মাথায় রাখেন। তারা সচেতন থাকেন। শচিন তো এ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি খুব বাছাই করে বিজ্ঞাপন করতেন। মূলত হেলথ ড্রিঙ্ক, সফট ড্রিঙ্ক, খেলার সরঞ্জাম এবং গাড়ির মতো বিজ্ঞাপনে বেশি আসতেন। তা সফট ড্রিঙ্ক নিয়েও তো কত বিতর্ক! এমনিতে সৌরভের রাইস ব্র্যান অয়েলের বিজ্ঞাপন নিয়ে কোনো বিতর্ক হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বিধি বাম। অসুখ তো কাউকে জানান দিয়ে আসে না। কী আর করবেন বেচারা সৌরভ।
কিন্তু 'মাই১১সার্কেল' নামে ফ্যান্টাসি ক্রিকেট অ্যাপের বিজ্ঞাপনে সৌরভের উপস্থিতি নিয়ে কি তা বলা যাবে? বোর্ড প্রেসিডেন্ট থাকার সময় সৌরভ এই বিজ্ঞাপন করেন। এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দেয়া থাকে। সেটা হলো, এই খেলার সঙ্গে আর্থিক ঝুঁকি জড়িত এবং এটা আসক্তি বা নেশা সৃষ্টিকারী। যেহেতু এই খেলার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ও ঝুঁকি আছে, তাই ভারতের অন্তত ছয়টি রাজ্যে আইনানুসারে এই খেলা নিষিদ্ধ করা হয়।
এখানে দুইটি প্রশ্ন উঠেছিল। প্রথম, বোর্ড সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও একটি ক্রিকেট গেমিং অ্যাপের বিজ্ঞাপন কেন করবেন সৌরভ? এখানে কি স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে না? দ্বিতীয় প্রশ্নটি নৈতিক। যে গেমিং অ্যাপ নেশার মতো, যেখানে আর্থিক ঝুঁকি আছে, সেটা সৌরভের মতো আইকন কেন করবেন? তার এই অ্যাপের বিজ্ঞাপনে থাকা মানে তো সৌরভকে দেখে কোটি কোটি বাচ্চা ছেলেমেয়ের এই নেশা ও আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা! কারণ, সৌরভ তাদের কাছে আইডল। তাহলে এই বিজ্ঞাপন কেন করবেন তিনি? বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে তার ভাবমূর্তি অসম্ভব উজ্জ্বল। তার কোনো আর্থিক সংকটও নেই। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল পদে আছেন। তারপরেও এই ধরনের একটি বিজ্ঞাপনে না থাকলে কী আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? আর এর ফলে সৌরভকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি।
প্রশ্ন এখানেই। সেলিব্রিটিকে দেখে মানুষ জিনিস কিনবেন, কোনো সংস্থার প্রতি আকর্ষিত হবেন। শাহরুখ খান একবার বলেছিলেন, যেদিন আমি আমার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখবো নীচে কেউ আমাকে দেখার জন্য নেই, সেদিন বুঝবো, অভিনেতা হিসাবে, শিল্পী হিসাবে আমারও মৃত্যু হয়েছে। এই লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন বলেই তো ক্রিকেটার, অভিনেতা ও অন্য ক্রীড়াবিদদের দিয়ে বিজ্ঞাপন করানোর জন্য মুখিয়ে থাকে সংস্থাগুলি। তারা থাকলে জিনিসও হিট।
বিপদও সেখানেই। বছর কয়েক আগে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে উত্তাল ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও সেলিব্রিটিদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ছিল। টলিউড, বলিউডের অভিনেতা, অভিনেত্রীরা বিজ্ঞাপনে ছিলেন, সংস্থার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের দেখে চিট ফান্ড সংস্থাগুলির প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মায়। তারা টাকা রাখেন। চিট ফান্ড কোম্পানিগুলি লাখ লাখ মানুষকে ঠকিয়েছে, তাদের পথে বসিয়েছে। তাহলে তার দায় ওই সেলিব্রিটিদের উপর কেন পড়বে না? তাদের বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্ত করছে।
শুধু টাকা পাচ্ছেন বলে বিজ্ঞাপন করবেন, প্রোডাক্টের দায় নেবেন না, একথা বলার সময় শেষ। এখন শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যমের যুগে সেলিব্রিটিদের সব কাজই সাধারণ লোকের আতশ কাঁচের তলায় থাকে। সাধারণ মানুষ সোচ্চার হন। দরকার হলে সমালোচনায় ভরিয়ে দেন। যেমন দীপিকা পাড়ুকোনের প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছিল, একটি সফট ড্রিংকসের বিজ্ঞাপন করার জন্য। যেমন একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির হয়ে বিজ্ঞাপন করার জন্য মহেন্দ্র সিং ধোনিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন নেট-নাগরিকরা। কারণ, ওই কোম্পানি ফ্ল্যাট তৈরি করে দিতে অনেক দেরি করেছিল বা দিচ্ছিল না। একটি জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট নুডলে এমএসজি আছে জানার পর অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিত, প্রীতি জিন্টাকে কম তুলাধুনো করা হয়নি। মামলাও করা হয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন তারপর বলেছিলেন, তিনি এরপর বিজ্ঞাপনে থাকার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হবেন।
রং ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপনের কাহিনি নিয়ে বিতর্ক তো আরো চমকপ্রদ। সেখানেও তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিজ্ঞাপন করেছেন। তারপর বিতর্ক। কেন এরকম বর্ণবাদী প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে থাকবেন সেলিব্রিটিরা? তাদের কি নীতির প্রতি, আদর্শের প্রতি কোনো দায় নেই? অর্থই সব! তাই যদি হয়, তা হলে বিজ্ঞাপনের দায়ও তাদের নিতে হবে।
জলে নামব, স্নান করব, অথচ যেমন বেনী তেমনই থাকবে, চুল ভেজাব না, তা কি হয়? বিজ্ঞাপন করবো, মানুষকে আকর্ষণ করবো, কোটি কোটি টাকা নেব, অথচ তার দায় নেব না, তা কি হয়? নীতি তো একটাই, যেমন কর্ম, তেমন ফল। তা হলে কর্মে শুধু অধিকার থাকবে, ফলভোগ করার বেলায় সেলিব্রিটিরা হাত গুটিয়ে নেবেন, এমনটা হয় না।