চ্যালেঞ্জের মুখে পুজো সাহিত্য
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭যুগটা এমনই ছিল৷ কিন্তু হঠাৎ যেন পাল্টে গেছে অনেক কিছু৷ সেইসব খুদেদের হাতে এখন পূজাবার্ষিকীর বদলে উঠে এসেছে অনলাইন গেম, কার্টুন আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ভার্চুয়াল জগৎ৷ তারা নতুন জামার মতো আর অপেক্ষা করে না শারদীয়া সংখ্যার জন্য৷ এই পরিবর্তনটা শুধু শিশুদের নয়, এসেছে বড়দের মধ্যেও৷ মুঠোয় ধরে থাকা স্মার্টফোনে বিশ্বজগতের সব অচেনাকে চেনা আর দুর্লভকে সুলভ করার বৃত্ত থেকে রেহাই নেই যে কারও! অথচ এই ই-যুগেও পুজোর চার-পাঁচ মাস আগে থেকে বড় বড় পত্রিকা গোষ্ঠী পুজোসংখ্যার বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে৷ কিন্তু, সেই বিজ্ঞাপন দেখে ক'জন আর শারদীয় সাহিত্য কেনেন?
বাংলার পুজো সাহিত্যের এতদিনের ঐতিহ্যের এহেন অবস্থা কেন? ডয়চে ভেলে খোঁজ নিতে পৌঁছে গিয়েছিল লেখক, সম্পাদক থেকে প্রকাশক, পাঠকের কাছেও৷ কী বলছেন তাঁরা?
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা ছোটগল্পের চর্চা করেন সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী৷ চন্দননগরে ‘গল্পমেলা’ নামের একটি সংগঠনে তিনি নিয়মিত ছোট ও বড়দের গল্প লেখানোর কর্মশালা করে আসছেন৷ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি শঙ্কিত৷ ব্লু হোয়েলের মারণ থাবায় ছোটরা যে আক্রান্ত হচ্ছে, তার জন্য তিনি বইকে নির্বাসন দেওয়ার হাল আমলের প্রবণতাকে দায়ী করছেন৷ ছোটদের খেলার মাঠ বা গল্পের বই আর টানে না৷ তবে গৌর বৈরাগী এ জন্য শুধু বিনোদনের পসরা বা তার আকর্ষণকে দায়ী করতে রাজি নন৷ তিনি দূষছেন অভিভাবকদেরও৷ গৌর বৈরাগীর মন্তব্য, ‘‘বাবা-মায়েরাই ছেলেমেয়েদের বই কেনায় উৎসাহ দিচ্ছেন না৷ ছোটরা একটি বই পছন্দ করলে, তার দাম যদি হয় ২৫০ টাকা, তখন অভিভাবকেরা আঁতকে ওঠেন৷ অথচ তার আগেই হয়তো ওই বাবা-মা শিশুটিকে আড়াই হাজার টাকার পোশাক কিনে দিয়েছেন৷’’
শিশুদের মধ্যে বিনোদনের যে সংক্রমণ, তার ছোঁয়াচ বড়দেরও লাগবে, এটাই স্বাভাবিক৷ তবে এ সময়ের সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘাড়ে সব দোষটা চাপাতে চাইছেন না৷ তাঁর কন্ঠে বরং আত্মসমালোচনার সুর৷ তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ বই কিনে কেন পড়বে? ভালো লেখা নেই বলেই পড়ার অভ্যেস কমে যাচ্ছে৷ এখন যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে দু -তিনজনকে বাদ দিলে বাকীরা নেহাতই ছাপোষা লেখক৷ তাঁরা নিজেদের লেখার বস্তু সেই মধ্যবিত্ত জীবনের গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন৷ একুশ শতকের গ্লোবাল বাঙালি সেই একঘেয়ে লেখা পড়বে কেন? যাঁরা লিখছেন, তাঁরা নতুন বিষয় নিয়ে ভাবছেন না৷ তাঁদের লেখায় এই সময়ের উপযোগী ভাবনা চিন্তা ধরা পড়ছে না৷ তাই পাঠকরা উৎসাহ হারাচ্ছেন৷ এ কথা বলে লাভ নেই৷’’
সভ্যতার অগ্রগমন পাঠকের সঙ্গে লেখকের দূরত্ব তৈরি করেছে, এমনটাই মনে করেন সঙ্গীতা৷ এরই ফল ভোগ করছে বাঙালির পুজোসাহিত্য৷ এখন অবসর বা একাকীত্ব বলে কিছু নেই৷ সোশ্যাল মিডিয়ার দাক্ষিণ্যে পাঠকদের আত্মপ্রকাশের জায়গা অনেক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আগে আত্মপ্রকাশের জায়গাটা ছিল সাহিত্য৷ এখন মাংস রান্না করে সেটাও প্রকাশের জায়গা রয়েছে৷ সেই অর্থে ফাঁকা সময় বলে কিছু নেই৷ ইনভলভ হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে৷ তবুও আমি বলব এসব সোশ্যাল মিডিয়া থাকা সত্ত্বেও ভালো লেখা থাকলে মানুষ পড়বেই৷’’
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখার গুণমান নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর সঙ্গে একমত সাহিত্যিক ও পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক জয়ন্ত দে৷ পত্রিকার দপ্তরে আসা নামি-অনামি লেখকদের গল্প পড়ে তাঁকে পত্রিকার জন্য বাছাই করতে হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘গুণমান কমেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ অতীতের দিকপাল সাহিত্যিকরাও আজ নেই৷ পাঠকের আগ্রহ কমার সেটা একটা কারণ তো বটেই৷ তবে বিনোদনের বিকল্প উপায় আমাদের এতই গ্রাস করছে যে, বই পড়ার আর সময় থাকছে না৷ এই সত্যিটাও অস্বীকার করার উপায় নেই৷ এখন একজন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকজন লেখক নন৷ তাঁকে লড়তে হয় ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের সঙ্গে৷’’
কলকাতা থেকে প্রকাশিত একগুচ্ছ পূজাবার্ষিকীর মধ্যে জয়ন্ত দে সম্পাদিত পত্রিকাটির বিক্রি বিপুল৷ তা সত্ত্বেও সমকালীন সাহিত্য নিয়ে তাঁর গলায় এমন হতাশা কেন? কার্যত আত্মসমালোচনা করেই তিনি বলেন, ‘‘আগে সংবাদপত্র বা পত্রিকাগোষ্ঠী লেখককে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিত৷ মালিকপক্ষ নবীণ লেখকদের উৎসাহ দিতো৷ এখন পত্রিকাগোষ্ঠীগুলি এই প্রজন্মের লেখকদের সেভাবে আর পৃষ্ঠপোষকতা করেন না৷ তাহলে কীভাবে সমকালীন সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে?’’
বাংলা সাহিত্যে পূজোবার্ষিকীর প্রসঙ্গ উঠলেই, যে প্রকাশনা সংস্থাটির নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তার নাম দেব সাহিত্য কুটির৷ ‘শুকতারা' ও ‘নবকল্লোল' ছাড়াও এই সংস্থা আলাদা পূজাবার্ষিকী বের করতো৷ এখন আর নতুন পূজাবার্ষিকী প্রকাশিত হয় না৷ সেই পুরনো সংখ্যাগুলিই পুনর্মুদ্রণ করা হয়৷ রায় পরিবারের মানসসন্তান ‘সন্দেশ' পত্রিকা সন্দীপ রায়ের হাত ধরে আজও প্রকাশিত হয়, এ কথাটা অনেকের জানাই নেই! এককালের সাড়া জাগানো এই শিশু-কিশোর পত্রিকা থেকে চলচ্চিত্র জগতের মুখোরোচক খবর তুলে ধরা পত্রিকা ‘প্রসাদ’ সব স্টলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর৷ ‘মৌচাক’, ‘উল্টোরথ’, ‘পরিবর্তন’ সেই কবেই হারিয়ে গেছে!
কলকাতার নামী প্রকাশনা সংস্থা ‘পত্রভারতী' প্রকাশিত ‘কিশোর ভারতী' পত্রিকা পাঁচ দশক পার করেছে৷ ৫০ বছর আগে শারদীয় সংখ্যার হাত ধরে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ৷ এই পত্রিকার সম্পাদক ও কলকাতার ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় কিন্তু পুজো সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী৷
পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে, এটা মানলেও তিনি বলেন, ‘‘বিনোদনে যে উপকরণই আসুক না কেন, বই পড়া বন্ধ হবে না৷ তাই ই-বুক সাফল্য পায়নি৷ অ্যামাজনকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে এই দেশ থেকে৷’’ ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘যখন আমাদের দেশে টেলিভিশন এসেছিল, তখনও ‘গেল, গেল’ রব উঠেছিল, কই বই পড়া কি বন্ধ হয়েছে?এখন আবার সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে হইচই হচ্ছে৷ আমি বলছি, বই-পত্রিকার পাঠক চিরকালই থাকবে৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
৩০ জানুয়ারির এই ছবিঘরটি দেখুন...