সু চির আমলে রোহিঙ্গা ইস্যু কোন পথে?
৭ জুলাই ২০১৭সম্প্রতি মিয়ানমারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব কেয়াও জেয়া সংসদকে বলেছেন, তারা যদি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনে কাউকে পাঠাতে চায়, তাহলে তাদেরকে সেই অনুমতি প্রদানের কোনো কারণ নেই৷ বিশ্বজুড়ে আমাদের মিশনকে এই ধরনের নির্দেশনা দেয়া আছে৷
জাতিসংঘ গত মার্চে এই তদন্তের উদ্যোগ নেয়ার পরই মিয়ানমার সরকার বলেছিল যে, তারা এই উদ্যোগকে সহায়তা করবে না৷ এমনকি আন্তর্জাতিক তদন্তের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন নোবেলজয়ী অং সান সু চি নিজেও৷ তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়ে দিতে পারে৷
রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর শত বছর ধরে মিয়ানমারের জাতিগত নিপীড়নের বিস্তর প্রমাণ রয়েছে৷ দশকের পর দশক ধরে সেখানকার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসাবে আখ্যা দিয়ে আসছে, যা তাদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে৷
স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানুষ যেমন তাদের নিপীড়নে অংশ নিচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনও আক্রমণ-হত্যায় অংশ নিচ্ছেন বলে খবর আসছে৷
এ অবস্থায় সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে গত মার্চে জাতিসংঘ যে প্রস্তাব আনে, তা থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখেছে মিয়ানমারের বৃহৎ দুই প্রতিবেশী ভারত এবং চীন৷
অন্যদিকে মিয়ানমার বলছে, তারাই এ ঘটনার তদন্ত করবে৷ সেখানে অন্যায় কিছু ঘটে থাকলে, সে জন্য তাদের তদন্তই যথেষ্ট৷
কেয়াও জেয়া বলেন, যেখানে অভ্যন্তরীণ কাঠামো ভেঙে পড়েনি, সেখানে কেন এ ধরনের অনাহুত চাপ দেয়া হচ্ছে?
গত বছর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের একটি দল গত বছর রাখাইন রাজ্যে সীমান্ত পুলিশের উপর হামলা করে৷ যাতে ন'জন পুলিশ নিহত হয়৷ এরপর সর্বশেষ এই সংঘাত শুরু হয়৷ সরকারি বাহিনী কঠোরভাবে অভিযান শুরু করে৷
রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে দেয়া এক প্রতিবেদনে উঠে আসে৷ যার মধ্যে গণহত্যা এবং গণধর্ষণের মতো ঘটনাও রয়েছে৷
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বর্তমানে প্রায় বন্দি জীবন কাটাচ্ছে৷ তাঁরা ঠিকমতো চলাফেরা এবং জীবিকা নির্বাহও করতে পারেন না৷ কারণ তাঁদের কাছে পরিচয়পত্র নেই৷ এ কারণে দিনে দিনে সেখানে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে৷
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই রোহিঙ্গাদের উপর বার্মিজ সরকার চেপে বসেছিল৷ তবে তখন নিপীড়ন থাকলেও অনেক অধিকারও ভোগ করতো৷
১৯৭৮ সালে সরকারি বাহিনীর অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে, এদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কথা বলা শুরু হয়৷ তখন মিয়ানমার সরকার ভেতরে ভেতরে নতুন নাগরিক আইন তৈরিতে হাত দেয়, যা ১৯৮২ সালে পাস হয়৷
সেই আইনের মাধ্যমেই কেড়ে নেয়া হয় এই জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব৷ সেখানে বলা হয়, ১৮২৩ সালের পূর্বে যাঁরা মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করেছেন, কেবল তাঁরাই সেখানকার নাগরিক হবে৷ অর্থাৎ নাগরিক হিসাবে যে নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর নাম রয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷
কোন গোষ্ঠী নাগরিকত্ব পাবে – তা নির্ধারণের এখতিয়ার দেয়া হয় এই আইনের অধীনে গঠিত কাউন্সিলকে৷
সামরিক সরকারের আমলে জাতিগত নিপীড়নের শিকার এই গোষ্ঠী গণতান্ত্রিক আমলে কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকবে – এমন আশা অনেকেই করেছিলেন৷
সু চির নেতৃত্বাধীন দল ক্ষমতার আশার পরও সেই আশা মিইয়ে যেতে থাকে৷ এর মাঝেই অনেকে আশা করেছিলেন, একদিন দেশটিতে বদলাবে সংবিধান৷ যাতে কমবে সামরিক খবরদারি, এই পথ ধরে একদিন বদলাবে নাগরিকত্ব আইনও৷
তবে এ বছরের প্রথম দিকে দেশটির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির অন্যতম উপদেষ্টা ইউ কো কি প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন৷ তিনি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কাজ করছিলেন৷
বার্মিজ মুসলিম কো কি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে মনে করা হতো৷ তাঁর মৃত্যুর ফলে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির মধ্যে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসা আরো কঠিন হয়ে গেল বলে অনেকেই মনে করছেন৷