বাঁদররা মত্ত চিপস-পপকর্নে
২২ এপ্রিল ২০১৩সুন্দরবন৷ ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট৷ বিশ্বের বৃহত্তম বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ৷ সামুদ্রিক ঘূর্নিঝড় হোক বা সুনামির প্রবল জলোচ্ছ্বাস, সুন্দরবনই প্রাকৃতিক ঢাল হয়ে সমস্ত দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে বাংলাদেশ এবং গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গকে৷ বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-সহ বেশ কিছু বিরল প্রজাতির স্থলচর প্রাণী, কুমির এবং পাখির বাসস্থানও এই সুন্দরবন৷ ম্যানগ্রোভ গাছের জঙ্গলে ঢাকা একাধিক ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখা যে জরুরি, এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা যে প্রায় আত্মঘাতী হওয়ার সামিল, সেটা কিন্তু প্রায়শই ভুলে বসে থাকে প্রশাসন এবং পর্যটন ব্যবসায়ীরা৷ ফলে প্রকৃতির সাম্রাজ্য জবরদখল করে, পরিবেশবিধি প্রায়শই না মেনে, পশ্চিমবঙ্গের দিকের সুন্দরবনে গড়ে উঠেছে একের পর এক পর্যটক আবাস বা ট্যুরিস্ট রিজর্ট৷ এই সব রিজর্টে থেকে যাঁরা সুন্দরবন দেখতে চান, তাঁরা তাঁদের শহুরে জীবনের সব রকম সুযোগ-সুবিধা এবং আরাম পেতে চান জঙ্গলে বসেই৷ ফলে এঁদের জন্যে জঙ্গলে জেনারেটর চালাতে হয়, চালু রাখতে হয় বাতানুকূল যন্ত্র এবং আয়োজন রাখতে হয় সব ধরনের খাবার, এমনকি তথাকথিত জাঙ্ক ফুডেরও৷
সমস্যা হলো, সুন্দরবনের বাঁদরেরাও এইসব জাঙ্ক ফুডের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে৷ প্রথমে রিজর্টের রান্নাঘর থেকে ফেলে দেওয়া খাবার, তার পর পর্যটকদের যত্রতত্র ফেলে দেওয়া পোট্যাটো চিপসের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল থেকে৷ অন্যরকম মজাদার স্বাদ জিভে লাগায়, এইসব খাবার পর্যটকদের হাত থেকে কেড়ে খেতেও শিখে গিয়েছে ওই বানর বাহিনী৷ আবার অনেকসময়ই পর্যটকরাই ওদের বাঁদরামি দেখে মজা পেতে ওদের হাতে তুলে দিয়েছেন এইসব অস্বাস্থ্যকর খাদ্য-পানীয়৷ ফলে একটু একটু করে বাঁদরদের খাদ্যাভ্যাসে বদল ঘটে গিয়েছে৷ বিপজ্জনক বদল৷ সুন্দরবনের বাঁদররা আর আগের মতো গাছের ফল-মূল, কচিপাতা বা কাঁকড়া ধরে খাচ্ছে না৷ তার বদলে তাদের নজর অসতর্ক পর্যটকদের হাতে ধরা চিপস-পপকর্নের প্যাকেটের দিকে৷ মৌমাছির চাক ভাঙা তাজা মধু আর তাদের মুখে রুচছে না, তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে কৃত্রিম মিষ্টি পানীয়ের স্বাদে৷
এই অভ্যাসবদলের ফলে সমস্যা হচ্ছে দুটো৷এক, আগে বাঁদরের দল খাবারের খোঁজে লোকালয়ে এলেও ফের জঙ্গলে ফিরে যেত৷ এখন তারা লোকালয়ের ধারেকাছেই ডেরা বাঁধছে৷ ফলে বাঁদরের উৎপাতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও যে বিপজ্জনক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, মানুষের এত কাছাকাছি থাকার কারণে নানা ধরনের রোগ সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে বাঁদরদের, যা গভীর জঙ্গলে মহামারীর মতোই ছড়িয়ে যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে গোটা সুন্দরবনেরই পরিবেশগত ভারসাম্য যে নষ্ট হবে, সেটা বলাই বাহুল্য৷
দ্বিতীয় সমস্যা, বাঁদরদের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাওয়াতেও প্রাকৃতিক স্থিতি কিছুটা নষ্ট হচ্ছে৷ প্রাণী-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গলে বাঁদরের দল যেমন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, জমিতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে হরিনের দল এবং অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীরা৷ কারণ বাঁদর গাছে উঠে যত ফল খায়, বা পাতা ছিঁড়ে খায়, তার থেকে বেশি ফল-পাতা নীচে ফেলে৷ গাছের তলায় হরিনেরা সেইসব কুড়িয়ে খায়৷ কিন্তু আরও একটা কারণ আছে বাঁদরের সঙ্গে হরিনের ঘুরে বেড়ানোর৷ সেটা একেবারে প্রাণের তাগিদ৷ বাঘ শিকার ধরতে এলে গাছের উঁচু ডালে বসা বাঁদর সেটা সবার আগে দেখতে পায় এবং চীৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, তাতে সাবধান হয়ে যায় হরিনের দলও৷ জঙ্গলের এই চিরাচরিত নিয়ম ব্যাহত হচ্ছে, ফাস্ট ফুডের লোভে বাঁদরের দল জঙ্গলছাড়া হওয়ায়৷
পরিবেশবিদরা বলছেন, ট্যুরিস্ট রিজর্ট হয়ত বন্ধ করা যাবে না, কিন্তু তাদের উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলাকে নিয়মে বাঁধতে হবে৷ ঢাকা আবর্জনার পাত্রে সেই উচ্ছিষ্ট ফেলে, প্রতি দিন নিয়ম করে সেটা পরিস্কার করতে হবে৷ আর বাঁদরদের খাবার দেওয়া বন্ধ করতে হবে পর্যটকদের৷ জঙ্গলের মধ্যে যত্রতত্র খাবারের প্যাকেট আর পানীয়ের বোতল ফেলা নিয়ম করে আটকাতে হবে৷ তেমন হলে জঙ্গলের সীমানার মধ্যে চিপস – পপকর্ন – কোল্ড ড্রিঙ্কস জাতীয় খাবার নিয়ে যাওয়াই নিষিদ্ধ করতে হবে৷ আচরণবিধি না মানলে শাস্তি বা জরিমানার নিয়ম তৈরি করতে হবে৷ কারণ, আজকে যা নেহাতই সামান্য এক সমস্যা বলে মনে হচ্ছে, কাল সেটাই ভয়ংকর চেহারা নিতে পারে৷ এর আগে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের জলে দূষণ ছড়িয়েছে৷ এছাড়া নিয়মিত বায়ুদূষণ তো আছেই৷ সময় থাকতে সাবধান না হলে এক বড়সড় পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে গর্বের সুন্দরবন৷