সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের বিপুল ‘সঞ্চয়’ বৃদ্ধি
১৭ জুন ২০২২ব্যাংকার এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামনে নির্বাচন, এটা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ৷ তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়াই মূল কারণ৷ সরকার চেষ্টা করলে এবং সদিচ্ছা থাকলে আইনগতভাবেই এখন এসব অনুসন্ধান ও ফেরত আনা সম্ভব৷
সুইস ব্যাংকে কত টাকা
২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আট হাজার ২৭৬ কোটি টাকা (এক ফ্রাঁ= ৯৫ টাকা)৷ ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা পাঁচ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা৷ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ এক বছরে রেকর্ড শতকরা ৫৫ ভাগ বেড়েছে৷ এটা এ পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ৷ সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক এসএনবি-র বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে৷
সুইস ব্যাংকে ২০০২ সালে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল মাত্র তিন কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ৷ দুই দশতে তা বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ৷
কেন বাড়ছে?
বাংলাদেশিদের অর্থ কেন বাড়ছে? যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকার মো. নুরুল আমিন বলেন, প্রতি জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়৷ তখন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়৷ নির্বাচনের আগের বছরগুলোর হিসাব দেখলে তা স্পষ্ট হবে৷ তবে এবার অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে গেছে৷ তার কথা, ‘‘নির্বাচন ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির পরিমাণ যখন বেড়ে যায়, তখন সুইস ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়৷ আবার অনেকে দেশে অনিরাপদ মনে করে, প্রাসীরাও টাকা সেখানে রাখতে পারে আর আমাদের ব্যাংকগুলোর সাথেও সুইস ব্যাংকের কিছু লেনদেন হয়৷ কিন্তু এবার যে পরিমাণে হয়েছে, তা উদ্বেগের বিষয়৷’’
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘দেশে আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি এবং আর্থিক অনিয়মে আগের চেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েছেন৷ তাই টাকা পাচারও বেড়ে গেছে৷ সেই তুলনায় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা সামান্যই৷ এখন টাকা পাচারের আরো অনেক দেশ আছে৷ গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেছে, ছয় বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে৷ সুইস ব্যাংকে আছে মাত্র আট হাজার কোটি টাকা, যা এক বিলিয়ন ডলারের মতো৷ তাহলে অনেক বেশি পুঁজি অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘সুইস ব্যাংকের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছে৷ এটা অনেক বেশি উদ্বেগের৷ দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যাসায়ী ও রাজনীতিবিদরা সেখানে টাকা পাঠাচ্ছে, বাড়ি-ঘর করছেন, সম্পদ তৈরি করছেন, স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তারাও চলে যাবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘শুধু একজন আজিজ খানের কাছেই সিংগাপুরে এক বিলিয়ন ডলার চলে গেছে৷’’
টাকা ফেরত আনা
বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের পতনের পর সুইস ব্যাংকে তার (এরশাদ) টাকা ফেরত আনার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ এই কাজে ফায়ার ফক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বও দেয়া হয়৷ কিন্তু সেই টাকা ফেরতের কোনো খবর আর পাওয়া যায়নি৷ তবে পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর থেকে টাকা ফেরত আনার উদাহরণ আছে৷ সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন সুইস ব্যাংকও চাপের মুখে আছে৷ আর চাপের কারণেই ২০১৪ সাল থেকে সে কোনো দেশের নাগরিকদের কত অর্থ আছে, তার পরিমাণ প্রকাশ করছে৷ তাকে মামলাও মোববেলা করতে হচ্ছে৷ সুইস ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন এখনো গ্রাহকের গোপনীয়তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও অপরাধে জড়িত গ্রাহকের তথ্য দিচ্ছে৷ ২০১৪ সালে কমন রিপোর্টিং ষ্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) গড়ে তোলে ১০০টি দেশ৷ তার আওতায় সদস্য দেশগুলো তার নাগরিকদের সব তথ্য সুইস ব্যাংক থেকে পায়৷ ২০১৭ সাল থেকে তারা তথ্য দিচ্ছে৷ ভারত, পাকিস্তান ও এমনকি মালদ্বীপও ওই প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ করেনি৷
বাংলাদেশ ২০১৪ সালে একটি উদ্যোগ নেয়৷ ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সুইজারল্যান্ডের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি দেয়৷ আর ২০১৩ সালে বিএফআইইউ এডমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পায়৷ এডমন্ট গ্রুপ হলো সব দেশের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর একটি জোট৷ এই ফোরাম অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন নিয়ে কাজ করে৷
বিএফআইইউ-র সাবেক প্রধান আবু হেনা রাজি হাসান জানান, ‘‘এডমন্ট গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিশ্বের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স গ্রুপগুলো তথ্য আদান-প্রদান করে৷ আবার বিভিন্ন দেশে তথ্য চাইলে তারা সাড়া দেয়৷ কিন্তু সেটা তাদের আইনের মধ্যে থেকে৷ এটা নিয়ে সারা বিশ্বে কাজ করছে ফাইনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স৷ তাদের চাপে এখন সুইস ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকই অবস্থান পরিবর্তন করছে৷ তথ্য দেয়৷ আগে তো মুখ বন্ধ ছিল৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তবে তথ্য নিতে হলে তাদের অপরাধের তথ্য-প্রমাণ দিতে হয়৷ আবার এডমন্ট গ্রুপের নিয়ম অনুয়ায়ী ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে তথ্য আনলে তা প্রকাশ করা যায় না৷ গোপন রেখে তার ওপর অনুসন্ধান করা যায়৷ আর ক্রিমিনাল ম্যাটার হলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্সের আওতায় করা করা যায়৷’’
তার কথা, ‘‘এখন পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, বিদেশের ব্যাংকে বাংলাদেশের টাকা নিয়ে কাজ করার সুযোগ বেড়েছে, তবে তা সময় ও সদিচ্ছার বিষয়৷’’
মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘এখন সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার নীতির কড়াকড়ি কমে এসেছে৷ আগে তো তারা কিছুই প্রকাশ করতো না৷ এখন কোন দেশের নাগরিকদের কত টাকা আছে তা প্রকাশ করে৷ তাদের নাম প্রকাশ করে না৷ এখন অনেক দেশ নানা চুক্তির অধীনে নাগরিকদের নামসহ তথ্যও পাচ্ছে৷ আমরাও চেষ্টা করলে পেতে পারি৷ আমরা আন্তর্জাতিক ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স জোট এডমন্ট গ্রুপের সদস্য৷ এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সদস্য৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তথ্য পেতে পারে৷’’
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে দেখিনি৷ তিনি নিজেই তো পুঁজি পাচারকারী৷ ওনার লন্ডনে বাড়ি আছে৷ তিনি কীভাবে লন্ডনে পুঁজি নিয়ে গেলেন, ওখানে বাড়ি করলেন?’’