মানবাধিকার পরিষদ
১ মার্চ ২০১২জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে নিন্দুকেরা ‘দন্তহীন বাঘ' নামে ডাকে৷ কারণ অতীতে দেখা গেছে, যে সদস্য রাষ্ট্রগুলি বার বার মানবাধিকার রক্ষার বদলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথই প্রশস্ত করে দিয়েছে৷ এবার সেই বদনাম দূর করার অভিনব সুযোগ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান৷ তারা এমন কড়া এক প্রস্তাব পাশ করতে পারে, যাতে বাশার আল আসাদ প্রশাসনকে সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনার জন্য দায়ী করা হবে এবং দুই বিবাদমান পক্ষের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবিরতির ডাক দেওয়া হবে৷ এমন এক অস্ত্রবিরতি সম্ভব হলে তবেই রেড ক্রস সংঘর্ষে জর্জরিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারবে৷ সেখানকার অসহায় মানুষের জন্য এই সহায়তা অত্যন্ত জরুরি৷
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপের পথ বন্ধ করে চলেছে মূলত রাশিয়া৷ মানবাধিকার পরিষদের ৪৭টি সদস্য দেশের উচিত, রাশিয়ার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া৷ রাশিয়া মানবাধিকার পরিষদে সিরিয়ার বিষয়টি উত্থাপনই করতে দিতে চায় নি৷ বিতর্কের শেষে কোনো বিবৃতি প্রকাশ করা হবে না – এই আশ্বাস পেয়ে তারপরই মস্কো রাজি হয়েছে৷ নিরাপত্তা পরিষদের মতো মানবাধিকার পরিষদে ভেটো প্রয়োগের কোনো ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও রুশ মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয় নি৷
এটা ঠিক, যে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই৷ কিন্তু এর একটা বিশেষ প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে৷ প্রায় এক বছর ধরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের জের ধরে সিরিয়ায় প্রায় ৮,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা ক্যাথরিন অ্যাশটন৷ শুধু গত সপ্তাহান্তেই প্রায় ১৫০ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে৷ এদের মধ্যে একটা বড় অংশই বিদ্রোহীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত হোমস শহরের নিরীহ মানুষ৷ গত কয়েক দিন ধরে হিংসার এক নতুন ও নাটকীয় মাত্রা দেখা যাচ্ছে৷
মানবাধিকার পরিষদের এক প্রস্তাব অনুমোদন হলে সিরিয়ার সরকার সম্ভবত ত্রাণ সরবরাহের জন্য এক ‘মানবিক করিডোর' খুলে দিতে রাজি হবে, যাতে করে রেড ক্রস তার কর্তব্য পালন করতে পারে৷ এই প্রশ্নে অবশ্য মস্কো কিছুটা নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে৷ এমনকি তারা এক্ষেত্রে সিরিয়ার সরকারের উপর তাদের প্রভাব খাটানোর আশ্বাসও দিয়েছে৷
জেনেভায় কূটনৈতিক স্তরে যখন দিনের পর দিন ধরে সঠিক ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তুঙ্গে, তখন সবার নেপথ্যে একেবারে আলাদা এক সমাধানসূত্র নিয়ে আলোচনা চলছে৷ জটিল পরিস্থিতি ও সিরিয়ায় খোলাখুলি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে চলায় পশ্চিমা কূটনীতিকরাও বাশার আল আসাদের নির্বাসনের সম্ভাবনা আর উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷ এই সমাধানসূত্রের আওতায় আসাদ পদত্যাগ করবেন৷ এর বদলে তিনি ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত কোনো পদক্ষেপ নেবে না৷ সিরিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত কোফি আন্নান'কেই সম্ভবত আসাদের কাছে এই প্রস্তাব পেশ করতে হবে এবং এর সুফলও বোঝাতে হবে৷ ইয়েমেনেও সম্প্রতি একই ধরণের সমাধানসূত্র কার্যকর করা হয়েছে৷ প্রাক্তন স্বৈরচারী শাসক আলি আব্দুল্লাহ সালেহ বিনা বাধায় দেশ ছাড়তে পেরেছেন৷ টিউনিশিয়ার সরকার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট'কে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত৷
সিরিয়ার আসাদ প্রশাসনের অপরাধের বোঝা কম নয়৷ এমন এক সরকারের প্রধানকে পিছনের দরজা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দেওয়া অবশ্যই নৈতিকতার বিচারে সঠিক কাজ হতে পারে না৷ কিন্তু এর বিকল্পের কথাও ভুললে চলবে না৷ বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলে আরও অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটবে৷ তাছাড়া আসাদের প্রস্থান ঘটলে সম্প্রতি বহুদলীয় গণতন্ত্র সংক্রান্ত বিতর্কিত গণভোটও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হতে পারবে৷
প্রতিবেদন: ডানিয়েল সেশকেভিৎস / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ