1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সিন্থেটিক না গ্রিন ন্যাপকিন?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘প্যাডম্যান'৷ অরুণাচলম মুরুগনন্থমের সস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির কাহিনীর চিত্রায়ন করেছে ভারতীয় চলচ্চিত্র৷ তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, এরপরেও সমাজ মহিলাদের ঋতু-সমস্যাকে সম্মান করতে শিখবে কি?

https://p.dw.com/p/2soOc
গ্রিন ন্যাপকিনছবি: DW/Payel Samanta

ঋতুকালীন সময়ে ভারতীয় মহিলাদের ৮৯ শতাংশ কাপড় ও ৭ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন, এমনটাই উঠে এসেছে সমীক্ষায়৷ তবে রয়েছে প্রবল সামাজিক বা ধর্মীয় বাধা৷ এই বাধা যাঁরা অতিক্রম করছেন, তাঁরাও কাপড় ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে৷ বিশ্বসুন্দরী মানুষী চিল্লর থেকে অভিনেত্রী সোনম কাপুরের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পরামর্শ ছেয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াসহ প্রায় সর্বত্র৷ গ্রামের মহিলাদের সুবিধার জন্য মহারাষ্ট্রের লাতুর, সোলাপুর, জলগাঁওয়ের ২০টি গ্রামে ‘স্যানিটারি প্যাড ব্যাঙ্ক' চালু করে দিয়েছেন ‘প্যাডম্যান' অক্ষয় কুমার৷

কিন্তু সেই স্যানিটারি ন্যাপকিন সবার হাতে পৌঁছানোর উপায় এখনও অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, সারা দেশের ২৩ শতাংশ গ্রামীণ মেয়ে ঋতুস্রাবের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য না হলেও মাসিকের কাপড় বদলানো, ধোয়ার অসুবিধার দরুণ এই পাঁচদিন তারা স্কুলমুখো হয় না৷ কারণ, প্রতি মাসে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য তাদের নেই (ইদানীং তাতে যুক্ত হয়েছে জিএসটি)! কলকাতার বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম রহমান স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুরুত্ব স্বীকার করে ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিকল্প নেই৷ কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহারের জন্য অবিবাহিত কমবয়সি মহিলাদের পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (পিআইডি) এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লক হচ্ছে৷ এর জন্য বন্ধ্যাত্বের হারও বাড়ছে৷''

Indien Kolkata Herstellung Menstruationstücher
তৈরি হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ‘গ্রিন ন্যাপকিন'ছবি: DW/Payel Samanta

গ্রামের মহিলারা কতটা সচেতন এ ব্যাপারে? পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড় ব্লকের মধুপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী স্বাতী পাল ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘স্কুল-কলেজে গিয়ে গ্রামের মহিলারাও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে শিখছেন৷ কিন্তু গ্রামের অনেক জায়গায় তো এসব পাওয়াই যায় না৷ তার উপরে ব্যয়সাপেক্ষ৷ সরকারের তরফে মাতৃত্বকালীন অবস্থায় জননীদের বিনামূল্যে প্যাড দেওয়া হলেও এমনিতে কিছু দেওয়া হয় না৷'' ওই গ্রামের সমাজকর্মী ও শিক্ষক এম কে মাহাতার মতে, ‘‘সরকার যেভাবে বিনামূল্যে পোলিও টিকা বা কন্ডোম জোগান দিয়ে পোলিও বা এইডস প্রতিহত করতে পেরেছে, মহিলাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য এখন বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাডও সরবরাহ করা উচিত৷''

শহরাঞ্চলে ছবিটা আবার অন্য৷ ডিসপোজেবল ন্যাপকিন ব্যবহারের বাড়াবাড়িতে ঘটছে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ৷ স্বচ্ছ ভারতের মাঠঘাট, নর্দমা থেকে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম, পাবলিক টয়লেট, নদীনালা সব কিছুতেই জমছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের পাহাড়৷ খোলা মাঠে কিংবা পথচলতি দৃশ্যপটে চোখে পড়ে ব্যবহৃত ডিসপোজেবল প্যাড নিয়ে কুকুর-বেড়ালের টানাটানি৷ দৃশ্যদূষণের পাশাপাশি ডিসপোজেবল এই ন্যাপকিনের প্লাস্টিক ঘটাচ্ছে পরিবেশ দূষণও৷ রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধি অভিনেত্রী দিয়া মির্জা স্যানিটারি ন্যাপকিনের ক্ষতিকর দিক মাথায় রেখে বায়োডিগ্রেডেবল ন্যাপকিন ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়েছেন৷

‘এই ন্যাপকিন পাঁচ বছর ও তার বেশি অবধি চলতে পারে’

এসব সমস্যা সমাধানের জন্যই গত কয়েক বছরে ভারতে বেশ কয়েকটি ‘স্টার্ট আপ' সংস্থা তৈরি হয়েছে৷ সিন্থেটিক ন্যাপকিনের পরিবর্তে আগেকার নরম সুতির কাপড়ে ভরসা রেখে তৈরি হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ‘গ্রিন ন্যাপকিন'৷ পশ্চিমবঙ্গ, তথা কলকাতার একমাত্র গ্রিন ন্যাপকিন প্রস্ততকারক সংস্থা ‘সমতা উওম্যান কেয়ার'-এর তরফে দীপক পাল ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘সিন্থেটিক স্যানিটারি ন্যাপকিন পলিমারজাতীয় বস্তু এবং টক্সিক কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি, সে জন্য মানবশরীরে চুলকানিসহ জরায়ু ক্যানসারের বিপদ পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে৷ গ্রিন ন্যাপকিনের কটন ফ্লানেলের শোষণ ক্ষমতা বেশি৷ তাই দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করতে অসুবিধা নেই৷ সে দিক থেকে কটন ফ্লানেল অনেক বেশি প্রাকৃতিক, নিরাপদ এবং আরামদায়ক৷'' দীপক পালের দাবি, ‘‘বায়োডিগ্রেডেবল বলে গ্রিন ন্যাপকিনে পরিবেশ দূষণেরও ভয় নেই৷ এই ন্যাপকিন পাঁচ বছর ও তার বেশি অবধি চলতে পারে৷ কাপড় পুনর্ব্যবহারের পুরোনো ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গ্রিন ন্যাপকিন ধুয়ে, সরাসরি রোদে শুকিয়ে আবার ব্যবহার করা যায়৷ প্রতি মাসের নিয়মমাফিক খরচার চেয়ে সে ক্ষেত্রে খরচও অনেক কম পড়ে৷''

দীপকের কথা পুরোপুরি মানতে চাননি ডা. রহমান৷ তাঁর মতে, ‘‘স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে অযথা গুজব ছড়িয়ে এর ভালো দিকটা চাপা দিলে চলবে না৷ মানতে হবে যে, কাপড় নয়, স্যানিটারি ন্যাপকিনই সেরা৷ মহিলাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং স্বল্প খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন মহিলাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷ তবে পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করা গেলে তো খুবই ভালো হয়৷'' দীপক পালের কথাকে সমর্থন করেছেন একটি বিমা সংস্থার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সোহিনী চৌধুরী৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসকেরা না মানতে চাইলেও, গবেষণা অনুযায়ী জরায়ুর ক্যান্সার বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ সিন্থেটিক ন্যাপকিন৷ এর মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ থাকে৷ বিজ্ঞাপনের চটকে এগুলিই মহিলারা ব্যবহার করেন৷''

সিন্থেটিক ও গ্রিন ন্যাপকিন নিয়ে চিকিৎসক মহলও দ্বিধাবিভক্ত৷ দক্ষিণ কলকাতার বিশিষ্ট স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এম সি প্রতিহার বলেন, ‘‘গ্রিন ন্যাপকিন প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে তৈরি বলে কোনও রকম অ্যালার্জির সম্ভাবনা থাকছে না৷ সিন্থেটিক প্যাডের থেকে নিশ্চয়ই সুতির কাপড় ত্বকের পক্ষে ভালো৷ ঠিকঠাক ধুয়ে পরিষ্কার করা বা রোদে শুকোনো হলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের চেয়ে এটা অনেক স্বাস্থ্যকর হতে পারে৷''

গ্রিন ন্যাপকিন কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু সেটা নয়, কীভাবে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে সংক্রমণের আশঙ্কা৷ এমনটাই জানালেন সাগর দত্ত হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসক হাসি দাশগুপ্ত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গ্রিন ন্যাপকিনের ক্ষেত্রে এটি স্টেরাইল অর্থাৎ জীবাণুশূন্য করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ পাশাপাশি হার্ড সোপ দিয়ে না ধুয়ে সফ্ট সোপ দিয়ে ধুতে হবে৷ স্যানিটারি ন্যাপকিনে এসব ঝঞ্ঝাট থাকে না বলে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে তৈরি হচ্ছে সেটা না জেনে গ্রিন ন্যাপকিন নিয়ে কিছু বলা যাবে না৷ ১২ ঘণ্টার বেশি যে কোনও প্যাড শরীরের সংস্পর্শে থাকলে ছত্রাক সংক্রমণ হতে বাধ্য৷ এটাও খেয়াল রাখতে হবে৷''

শহরে গ্রিন ন্যাপকিনের আগমন হলেও তেমন সাড়া পড়েনি৷ দীপক পাল জানালেন, গত ৪ বছরে মাত্র দু'টো অনলাইন অর্ডার পাওয়া গিয়েছে৷ কলকাতার মহিলারা স্যানিটারি ন্যাপকিনে অভ্যস্ত৷ তার বাইরে অন্য কিছু ভাবছেন না৷ তবে কলকাতার তুলনায় দিল্লি, রাজস্থান এবং দক্ষিণ ভারতে গ্রিন ন্যাপকিন যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে৷ আবার এই ন্যাপকিন নিয়ে মেদিনীপুর এবং সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের সচেতনতা শিবিরে যথেষ্ট সাড়া মিলেছে৷ সংস্থার তরফে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মহিলাদের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন তিনি৷  

স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে অল্প খরচে গ্রিন ন্যাপকিন যদি গ্রামের দরিদ্র সাধারণ মহিলাদের কাছে পৌঁছে যায়, তবে তা নিঃসন্দেহে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানে এমনটাই উঠে এলো অনেক সাধারণ মহিলার বক্তব্যেও৷ অনেকে আবার জীবাণুমুক্তকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয়ে৷ কিন্তু সামাজিক ট্যাবু, লোকচক্ষু এবং অন্ধবিশ্বাসকে জয় করে মহিলারা নিজেদের ন্যাপকিন নিয়ে স্বচ্ছন্দ হতে পারবেন তো? সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘প্যাডম্যান চ্যালেঞ্জ' নিয়ে বলিউড যেখানে সরগরম, সেখানে এ দেশের মহিলারা চ্যালেঞ্জটা নিতে পারলেন কিনা, তা সময়ই বলবে!