সাহসী নারী ‘বীরপ্রতীক’ ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান
৩১ জানুয়ারি ২০১২১৯৪৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের৷ বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা৷ তবে বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ১৯৭০ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সিতারা৷ এসময় তাঁর বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন৷ স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন সিতারা৷
ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট সিতারা রহমান জানালেন কীভাবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাক সেনারা যখন বাঙালিদের উপর হামলা শুরু করল, তখন আমি এক মাসের ছুটিতে ছিলাম৷ ছুটিতে আমি কিশোরগঞ্জে আব্বা-আম্মার কাছে আসি৷ আমার সাথে ভাইয়াও এসেছিলেন৷ তবে ভাইয়ার ছুটি ছিল মাত্র এক সপ্তাহ৷ ভাইয়া ছুটি শেষ করে চলে গেলেন৷ কিন্তু আমি বাসায় থেকে গেলাম৷ মার্চ মাসে হত্যাকাণ্ড শুরুর পর কুমিল্লা কম্বাইন্ড মেডিকেল হসপিটাল - সিএমএইচ থেকে তিনটা-চারটা টেলিগ্রাম আসতে লাগল৷ আমাকে ময়মনসিংহ সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ বেশ কিছু কাছাকাছি স্টেশনের উল্লেখ করে কাজে যোগ দিতে বলা হলো৷ কিন্তু আব্বা মিথ্যা কথা লিখে টেলিগ্রামের জবাব দিলেন৷ একবার লিখলেন, সিতারা অসুস্থ৷ তারপরেও কাজে যোগ দিতে বলা হয়৷ তখন বাবা লিখলেন, তার পা ভেঙে গেছে৷ তাই হাঁটতে পারে না৷ এভাবে কিছুদিন টেলিগ্রাম লেনদেন হলো কিন্তু আমি কাজে যোগ দিলাম না৷ এর মধ্যেই একদিন দেখলাম ভাইয়া তৎকালীন মেজর নাসিম এবং ভারতীয় একজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসলেন৷ আমি তো আশ্চর্য যে, কী ব্যাপার? তখন ভাইয়া থানায় গিয়ে বৈঠক করলেন এবং জানালেন যে, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের মধ্যে একটি সেতু উড়ানোর জন্য আমরা এসেছি৷ তো সেতুটি উড়ানোর সময় খুব জোরে শব্দ হবে৷ তাতে আপনারা কেউ আতঙ্কিত হবেন না৷ ভাইয়ারা খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যায় চলে গেলেন৷ এর পরদিনই ঐ এলাকায় পাক সেনাবাহিনীর বিমান উড়তে থাকল৷ কিছু কিছু জায়গায় তারা বোমা ফেললো৷ আমাদের ভয় হচ্ছিল যে, আমরা যেহেতু সেনাবাহিনীতে চাকুরি করতাম, তাই আমাদের বাসার ঠিকানা তো পাক সেনাদের কাছে রয়েছেই৷ ফলে তারা আমাদের ধরতে আসতে পারে৷ তাই আমরা বড়বাগ গ্রামে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় কয়েকদিন থাকলাম৷''
চিকিৎসক ও সেনা সদস্য সিতারা রহমান তখন শুধুই পথ খুঁজছিলেন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগানো যায়৷ এর মধ্যেই ভাই মেজর হায়দারের চিঠি পান সিতারা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ এরপর কীভাবে আগরতলা পাড়ি জমান সিতারা এবং তাঁর পরিবার, সেব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘জুলাই মাসের শেষ দিকে ভাইয়া দু'টি ছেলের হাতে পেন্সিল দিয়ে লেখা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন৷ চিঠিতে তিনি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন৷ বিশেষ করে আমাকে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন সেটাও উল্লেখ করেন৷ এছাড়া তাদের হাতে আমার জন্য একটা ছোট পিস্তল পাঠিয়েছিলেন৷ এই নির্দেশ দিয়ে যে, যদি পথে কোথাও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ি, তাহলে যেন আমি সেই পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করি৷ তো আমি ভাইয়ার পাঠানো সেই ছোট্ট পিস্তলটা ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতাম৷ পরেরদিন আমরা রওয়ানা করলাম৷ গ্রামের মেয়েদের মতো শাড়ি পরে খালি পায়ে আমি অন্যদের সাথে রিক্সায় উঠলাম৷ গুজাদিয়ার ঘাটে এসে নৌকায় উঠলাম৷ নৌকায় সাত দিন সাত রাত কাটিয়ে আমরা সিলেট সীমান্ত দিয়ে টেকেরঘাট পৌঁছি৷ সেখানে পৌঁছার পর দেখি ভাইয়া এসে হাজির৷ অথচ আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না৷ কিন্তু তারপরও কীভাবে ভাইয়া আমাদের খবর জানলেন সেটা এখনও একটা রহস্য বলে মনে হয়৷ এর মধ্যে ভাইয়া এক ভারতীয় মেজরকে বলে রেখেছিলেন যে, আমার পরিবারকে নিয়ে যাবো, একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে৷ সে অনুসারে সেই মেজর একটি পিকআপ ভ্যান রেখেছিল আমাদের জন্য৷ কিন্তু পেছনে দেখি সিমেন্টের বস্তা ভর্তি৷ এটা দেখে প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে বুঝলাম যে, খুব উঁচু-উঁচু বোল্ডারের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িটি যেন খুব বেশি লাফাতে না থাকে, সেজন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই সিমেন্টের বস্তা রাখা হয়েছিল৷ সেই পিকআপে করে আমরা বালাটে পৌঁছি৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক