সাকিবদের প্রতি দুর্বলতা ভারতীয় বাঙালির
২৬ জুন ২০১৯ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসরে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ৷ প্রথম চারে শেষ করে নকআউট পর্বে খেলতে টাইগাররা মরিয়া৷ অন্য দিকে ভারত সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে আগামী ২ জুলাইয়ের ম্যাচ বাংলাদেশের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। সাকিব-মাশরাফীদের এখনো বিশ্ব ক্রিকেটের নবোদিত শক্তি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু, গত কয়েক বছরে তারা যে দ্রুত গতিতে নিজেদের পারফরম্যান্সে উন্নতি ঘটিয়েছে, তার ফলে ক্রিকেটের শক্তিধর দেশগুলির সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছে। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দাপুটে ব্যাটিং নজর কাড়ছে। তা নিয়ে এই বাংলার সর্বত্র আলোচনাও চলছে। চায়ের দোকান থেকে ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের আড্ডায় ঘুরেফিরে আসছে টাইগারদের প্রসঙ্গ৷
ব্যারাকপুর থেকে রোজ ট্রেনে কলকাতার অফিসে যান বেসরকারি সংস্থার চাকুরে বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন , ১১টা বাঙালি ছেলে খেলতে নামছে, এটা ভাবলেই তো ভালো লাগে। তাই বাংলাদেশের ম্যাচ মিস করি না। ওদের সাফল্য আমাদের কাছেও গর্বের।দমদম থানা এলাকার দুর্গানগর রেল স্টেশনে মদনদার চায়ের দোকানে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে একই কথা। এই পথে যাতায়াতকারী শিক্ষক অনির্বাণ হাজরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমাদের দলে একজনও বাঙালি নেই। জানি না ভবিষ্যতে কবে থাকবে? সেজন্য খারাপ লাগে। কিন্তু, সাকিবরা যখন খেলতে নামে, তখন সেই আক্ষেপ অনেকটাই পুষিয়ে যায়। ক্লাবে ক্লাবে ম্যাচের সময় টিভির সামনে ভিড়। সাকিবের সেঞ্চুরির পর সকলে সোৎসাহে হাততালি দিয়ে উঠেছেন, যেন এইমাত্র রোহিত শর্মা ১০০ করেছেন!
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচের ক্ষেত্রে এই ক্রিকেটপ্রেমী জনতার মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া মেলে, বাংলাদেশের বেলায় তা একেবারেই আলাদা। সল্টলেকের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত তরুণ শঙ্কর চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের চিরশত্রু। যে কোনও লড়াইয়ে ওদের হারাতে হবে। সে সীমান্তের যুদ্ধ হোক কিংবা ক্রিকেটের মাঠ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা আসে না। গড়িয়ার কলেজ ছাত্রী তনুজা সরকারের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা আবৃত্তি করে ছোটবেলায় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ইতিহাসের ছাত্রী তনুজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, এপার বাংলায় কবির জন্ম, কর্ম। ওপার বাংলায় চিরঘুমে তিনি শায়িত আছেন। ব্রিটিশরা মাঝে কাঁটাতার বসিয়ে দিলে কি নজরুলকে ভাগ করা যাবে?
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল । দেশভাগের শিকার যে মানুষরা এই বাংলায় এসেছেন, শিকড়ের টান এখনও তাঁদের ওপারের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে। ১৯৪৭-এ হুগলির সিংহরায় পরিবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল। মায়ের কোলে চেপে সীমান্ত পার করেছিলেন করুণকান্তি সিংহরায়। তখন তাঁর এক বছর বয়স। প্রবীণ মানুষটি ডয়চে ভেলেকে বলেন, খেলা শুরুর আগে অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীত বুঝতে পারি না। শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বুঝতে পারি, যেহেতু তা আমার মাতৃভাষায় লেখা। ওই গানটিও আমার খুব প্রিয়। সাকিবরা চ্যাম্পিয়ন হলে খুশি হব।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচে ভারতীয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসে। সেটা কেউ লুকোতেও চান না। মঙ্গলবার আপনার সমর্থন কার দিকে থাকবে? এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই কয়েক মুহূর্ত থমকে গেলেন। যাঁদের এক লহমায় নিজের দেশের নাম বলার কথা, তাঁদের মধ্যে দ্বিধার চোরাস্রোত। বাংলার ক্রিকেট প্রশাসনের প্রাক্তন কর্তা বিশ্বরূপ দে একটু থমকে বললেন, ভারতীয় হিসেবে আমার দেশের প্রতি সমর্থন থাকবেই। তবে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা আছে। ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষের না থাক, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের তো আছেই। ২০১৫ সালে বিরাট কোহলির ভারতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে বিশ্বরূপ বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। তার বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেট জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। তাঁর বক্তব্য, বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে দারুণ উন্নতি করেছে। খুব ভালো খেলছে ওদের ক্রিকেটাররা। ওরা সাফল্য পেলে আমাদেরও ভালো লাগে। বাংলাদেশের অনেক তারকা কম বয়সে কলকাতায় খেলতে এসেছিলেন। তখন থেকে অনেককেই চেনেন বিশ্বরূপ। তাঁর মতে, দুই বাংলার এই আবেগের কারণ ভাষা। সেটাই আমাদের জুড়ে রেখেছে।
দুই দেশেই মৌলবাদীরা ধাক্কা খাচ্ছে এই ভাষাগত বন্ধনের জোরেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধর্মীয় পরিচয়কে হারিয়ে ভাষাকে জিতিয়ে দিয়েছিল। ক্রিকেটের মাঠ ও তার দর্শকদের মধ্যেও সেই চেতনা টোল খায়নি। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বহুপঠিত পুব পশ্চিম কবিতায় লিখেছেন, আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে, তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায়। এই আত্মীয়তা বজায় রেখেই তামিম-লিটনদের বিরুদ্ধে দেশের জয় চাইবে ভারতীয় বাঙালিরা।