সাদা চোখে দেখলে সাইপ্রাসের জাতিগত বিভাজন বোঝা কঠিন৷ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় এই দ্বীপটিতে প্রতিবছর ২০ লাখের মতো পর্যর্টক আসেন৷ তার মধ্যে আবার অধিকাংশই ব্রিটিশ নাগরিক৷ এসব পর্যটকদের জন্য লিমাসল, পাফোস, লার্নাকার মতো সাগর পারের শহরগুলোতে রয়েছে নানা আয়োজন৷
তবে, পর্যটকদের এই আলোচনা বাদ দিয়ে একটু ভেতরের দিকে তাকলে দেখা যাবে এক রুঢ় বাস্তবতা৷ যে বাস্তবতা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে বিভিক্ত করে দিয়েছে একটি দেশকে৷
ভৌগোলিকভাবে এশিয়ার মধ্যে পড়া সাইপ্রাস দ্বীপটির অবস্থান এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের খুব কাছে৷ ফলে অতীতে এই দ্বীপটি যারাই শাসন করেছেন, সামরিক কৌশলগত দিক থেকে তারা লাভবান হয়েছেন৷ একসময় রোমানদের দখলে থাকা দ্বীপটি অটোমানদের হাত ঘুরে ১৮৭৮ সালে চলে যায় ব্রিটিশ সম্রাজ্যের অধীনে৷ ব্রিটিশরা তখন ভারতবর্ষ শাসনের স্বার্থে সুয়েজ ক্যানেল দখলে রাখতে মরিয়া৷ তাই সাইপ্রাসের দখলে পেয়ে তারা বেশ সন্তুষ্ট ছিল৷
ব্রিটিশরা দ্বীপটিতে শিক্ষাব্যবস্থা চালু থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহরকে সাজাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে৷ ভূমধ্যসাগরের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপটিতে তারা উন্নয়নের পাশাপাশি আরো একটি কাজ করেছে৷ তাহচ্ছে গ্রিক বংশোদ্ভূত সিপ্রিয়ট এবং তুর্কি বংশোদ্ভূত সিপ্রিয়টদের আলাদাভাবে শনাক্ত করা৷ গ্রিক এবং তুর্কি সিপ্রিয়ট, উভয়েই এই দ্বীপের বাসিন্দা৷ কিন্তু ধর্ম এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল৷ সেই পার্থক্যটাকে বড় করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছে চতুর ব্রিটিশ শাসকরা৷
ফলে একসময় যখন সিপ্রিয়টদের মধ্যে স্বাধীনতার মানসিকতা ব্যাপক আকার ধারন করলো, তখন সেটা মেনে নিলেও এই বিভাজনকে জিইয়ে রাখলো ব্রিটিশ শাসকরা৷ ১৯৬০ সালে সাইপ্রাসকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার সময় এক চুক্তিতে দেশটিতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায়' গ্রিস এবং তুরস্ক ভবিষ্যতে সামরিক উদ্যোগ নিতে পারবে, এমন এক বিধান রেখে দেয়া হলো৷ পাশাপাশি দ্বীপটির দুটো অংশে নিজেদের সামরিক উপস্থিতিও নিশ্চিত করে ইংরেজরা৷
গ্রিক এবং তুর্কি সিপ্রিয়টদের মনে যে বিভাজনের রেখা ব্রিটিশ শাসকরা আঁকতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটা বড় সংঘাতে পরিনত হতে বেশি সময় লাগেনি৷ ১৯৭৪ সালে গ্রিক সেনাবাহিনী দ্বীপটিকে গ্রিসের অংশ করতে সেখানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির জাতির জনক মাকারিয়াসকে ক্ষমতাচ্যুত করে৷ আর সেই সুযোগ নেয় তুরস্কও৷ সেসময় মার্কিন এবং ব্রিটিশ ইন্ধনে দ্বীপটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে তুর্কি সেনারা৷ দখল করে নেয় দ্বীপটির উত্তরাঞ্চলের ৩৫ শতাংশ এলাকা৷ তুর্কি সিপ্রিয়টরা চলে যান সেই অংশে৷ আর গ্রিক সিপ্রিয়টরা সবকিছু ফেলে চলে আসেন দেশটির দক্ষিণাংশে, যেখানে গ্রিসের আধিপত্য বেশি৷
তুর্কি ও গ্রিক সিপ্রিয়টদের মধ্যকার বিরোধ মেটাতে দ্বীপটিতে তখন হাজির হয় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী৷ দুই পক্ষের মধ্যে ‘যুদ্ধবিরতি সীমানা' টেনে তৈরি করা হয় বাফার জোন, যা এখনো জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷
সিপ্রিয়টদের স্বাধীনতার স্বপ্ন তাই দিনের শেষে চূড়ান্ত বিভাজনে রূপ নিয়েছে৷ বর্তমানে দ্বীপটির ৬০ শতাংশ রয়েছে গ্রিক সিপ্রিয়টদের দখলে, ৩৫ শতাংশ তুর্কি সিপ্রিয়টদের৷ আর বাকিটা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী আর জাতিসংঘের দখলে৷ গ্রিক সিপ্রিয়ট অংশটি আন্তর্জাতিকভাবে সাইপ্রাস রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত, আর তুর্কি সিপ্রিয়ট যে অংশ সেটাকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে শুধু একটি দেশ - তুরস্ক৷ আর সেই অংশের নাম ‘টার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাস (টিআরএনসি)৷'
মজার বিষয় হচ্ছে এই যে বিভাজন সেটা দেশটিতে গেলেই চট করে বোঝার উপায় নেই যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি রাজধানীতে যাচ্ছেন অথবা পতাকাগুলো খেয়াল করছেন৷ আমি এবং আমার সহকর্মী অনুপম দেব কানুনজ্ঞ লার্নাকা বিমানবন্দরে নামার পর প্রায় সর্বত্রই সাইপ্রাসের পতাকার সঙ্গে গ্রিক পতাকা উড়তে দেখেছি৷ কোথাও কোথাও শুধু গ্রিক পতাকাও উড়ছে, কোথাও একসঙ্গে গ্রিস, সাইপ্রাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা৷ বোঝাই যায় এই অংশে গ্রিসের নানা কারণে ভালো রকম প্রভাব রয়েছে৷
দুই দেশের বিভাজনটা ভালোভাবে বোঝা যায় রাজধানী নিকোসিয়াতে গেলে৷ সাইপ্রাসের কেন্দ্রের এই শহরটির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বাফারজোন৷ আমরা যখন সেই বাফার জোন পার হয়ে সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চলে যাবো, তখন কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়লাম৷ গ্রিক সাইপ্রাস অংশের যুদ্ধবিরতি রেখার কূটনৈতিক অংশের চেকপোস্ট থেকে এক পুলিশ সদস্য বের হয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় যেতে চাই?
আমি সরল মনে জবাব দিলাম, টিআরএনসি৷
আমার উত্তর শুনে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন সেই কর্মকর্তা৷ বললেন, টিআরএনসি বলে কোনো রাষ্ট্র নেই৷ আমি তখন বললাম, তাহলে সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চলকে কী বলেন? নানা কথা বলার পর তিনি জানালেন, ওটা তুরস্ক জোর করে দখল করে রেখেছে৷
আমি আর কথা বাড়াইনি৷ তবে, বাফার জোন পাড়ি দিয়ে যখন তুর্কি সাইপ্রাস অংশের সীমানায় গেলাম, সেখানে চেকপোস্টে বেশ বড় করে লেখা দেখলাম, ‘‘টার্কিশ রিপাবলিক অব নর্থ সাইপ্রাস - ফরএভার৷''
সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চলের চিত্রও একইরকম৷ টিআরএনসির নিজস্ব পতাকা রয়েছে৷ আর সেই পতাকার সঙ্গেই প্রায় সর্বত্র ওড়ে তুরস্কের পতাকা৷ উত্তর সাইপ্রাসে তুরস্কের প্রভাব এতটাই যে সেখানে ঘরে ঘরে যে পানি সরবারহ করা হয় সেটাও ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে পাইপে করে ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসে তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে৷
দুই সাইপ্রাসকে মিলিয়ে দিতে অবশ্য নানা পর্যায় থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ ২০০৪ সালে যখন সাইপ্রাসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত করা হয়, তখন পুরো দ্বীপটিকে একটি রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হয়৷ যদিও বাস্তবে উত্তর সাইপ্রাসের উপর দক্ষিণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ আর সেসময় জাতিসংঘ একটি গণভোটের আয়োজন করেছিল৷ তাতে তুর্কি সিপ্রিয়ট ভোটারদের ৬৫ শতাংশ ছিলেন মিলে যাওয়ার পক্ষে, কিন্তু গ্রিক সিপ্রিয়টদের অধিকাংশই ভোট দিয়েছেন বিপক্ষে৷ ফলে দুই অংশের মিলন ঘটেনি তখন৷
৪৭ বছর ধরে বিভক্ত সাইপ্রাসের আরেকটি চেকপোস্ট দিয়ে ফিরেছিলাম৷ সেখানকার পরিস্থিতি অবশ্য পুরোই ভিন্ন৷ নানারকম দোকানপাটের মধ্য দিয়ে চলে গেছে চেকপোস্ট৷ সিপ্রিয়ট, ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকরা এবং বৈধভাবে ইইউতে বসবাসরতরা সেখানে পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র দেখিয়ে সহজেই একাংশ থেকে অন্যত্র চলে যেতে পারেন৷ তবে টিআরএনসি বা নর্থ সাইপ্রাসে থাকা অভিবাসীরা বৈধভাবে এই সীমানা পাড়ি দিতে পারেন না৷
শুরুর ছবিটা সেই চেকপোস্টের৷ আমার পিছনে দেখা যাচ্ছে চারটি পতাকা৷ বাকি পতাকাগুলো দেখেছি আলাদা আলাদা স্থানে৷ এক ছবিতে সবগুলো আঁটেনি৷