সাংবাদিক উৎপলের খোঁজ নেই এখনো
৩ নভেম্বর ২০১৭গত ১০ অক্টোবর ঢাকার মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে উৎপল দাসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷ সেই সময় তাঁর দু'টি মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়৷ ঘটনার ১২ দিন পর মতিঝিল থানায় উৎপলের কর্মস্থল ‘পূর্ব-পশ্চিমবিডি' কর্তৃপক্ষ সাধারণ ডায়েরি করে৷ উৎপলের বাবাও পরে আরেকটি জিডি করেন৷
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার ছেলে উৎপল দাস৷ তাঁর বাবা চিত্ত দাস সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ এখন তিনি স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রিন্সিপাল৷ সবশেষ খবর জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এতগুলো দিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত কোনো খবর নাই৷ প্রশাসনের দিক থেকে কিছুই জানায়নি৷ শুধু বলে যে ‘চেষ্টা করছি'৷ সাংবাদিকরা ডেকেছিল, তাই ঢাকায় গিয়ে তাদের সাথে মানববন্ধনে যোগ দিয়েছিলাম৷ এমনিতে পুলিশের সাথে কোনো কথা হয়নি৷''
পূর্বপশ্চিমবিডি'র সম্পাদক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ আমাদের কাছে কোনো আপডেট নেই৷ আমরা চেষ্টা করছি, যেমন ব়্যাবের ডিজি'র সাথে দেখা করেছি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে কথা বলেছি৷ আমাদের জায়গা থেকে যে যে জায়গায় যাওয়া সম্ভব, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি৷''
‘‘সাংবাদিকরা নানা প্রতিবাদ করে যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যাঁদের সাথেই আমরা কথা বলছি, আমার মনে হয়েছে তাঁরা যথেষ্ট আন্তরিক৷ উৎপলের বাবা জানালো, দুদিন ধরে থেকে থেকে তিনি ফোন করে উৎপলের ফোন খোলা পাচ্ছেন৷ আবার তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে এক বন্ধুকে এসএমএস পাঠানো হয়েছে৷ এগুলোকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি৷ তবে আমরা আসলে শুনতে চাই যে, উৎপল নিজে কাউকে ফোন করে বলছে যে সে সুস্থ আছে৷''
উৎপল দাসের নিখোঁজ হওয়াকে অবশ্য বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখছেন না সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ৷ তিনি মনে করেন, দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থায় এখন গণতান্ত্রিকতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন না থাকারই প্রমাণ এই ঘটনা৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যে দেশের সরকার ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক কোনো আচরণ থাকে না এবং যে দেশে সরকারকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে হয়, সে দেশে এই ধরনের গুমের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷''
মাহফুজ উল্লাহ আরো বলেন, ‘‘গত কিছু দিনে দুটি প্রবণতা আমরা দেখছি৷ এক হলো, একজন ব্যক্তি হঠাৎ উধাও হয়ে যান, এর দু'তিন মাস পর তিনি হয়তো উদ্ধার হলেন, কিন্তু এসে আর কোন কথা বলতে পারেন না বা বলবার মতো সাহস রাখেন না যে, ওই সময় সে কোথায় ছিল, কেমন ছিল, কার কাছে ছিল৷ আরেকটি প্রবণতা হলো, গুম হয়ে যাওয়ার পরে সেই মানুষটি আর ফিরে আসে না৷ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে আমি বলবো, সততার সাথে কাজ করার যে ক্ষমতা সেটি দমন করতেই পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে৷ এইসব দিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে যাতে সাংবাদিকরা খুব বেশি সমালোচনামুখর হতে না পারে সরকারের৷''
এসব ঘটনায় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘ যেহেতু সাংবাদিকরা এখন দ্বিধাবিভক্ত, ফলে প্রত্যেকেই রাজনীতির ভিত্তিতে অবস্থান গ্রহণ করেন৷ একদল মনে করে, বেশি কঠোর অবস্থান নিলে সরকার বিপক্ষে চলে যাবে, আরেকদল মনে করে, যত বেশি দরকার তত কঠোর হতে হবে৷ আসলে এ দ্বিধাবিভক্তির সুযোগটা নেয়া হয়৷''
‘‘এ ধরনের ঘটনায় নিঃসন্দেহে হতাশা তৈরি হয়৷ এটি মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নষ্ট করে, সরকার সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা তৈরি হয় এবং এর ফলে কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তারা মনে করে, সমালোচনা করলে সরকারের পতন হয়ে যাবে, আসলে তো তা নয়- এই কথাটি তারা বুঝতে চায় না,'' যোগ করেন তিনি৷
দেশে দীর্ঘদিন ধরেই একের পর পরসাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সুরাহা খুব কমই হযছে৷ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স স্যানস ফ্রন্টিয়ার্স বা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে এক বছরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ৪৭টি৷ আর সিটিজেন সাংবাদিক হত্যা ৫, গণমাধ্যম সহকারী হত্যার সংখ্যা ৮৷ কারাভোগ করেছেন ১৬৭ সাংবাদিক, ১১৩ জন সিটিজেন সাংবাদিক ও ১৩ জন গণমাধ্যম সহকারী৷ তাদেরই হিসেবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে আব্দুল হাকিম শিমুল নামে এক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়৷ আর গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২টি৷
যদিও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সূচক ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১৬'তে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৪তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ এবং আগের দুই বছরের তুলনায় সূচকে খানিকটা উন্নতি হয়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম৷
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, কেবল ২০১২ সালে বাংলাদেশে ৩ শতাধিক সাংবাদিক নির্যতনের শিকার হয়েছেন৷
গত ২১ বছরে হত্যার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৭ টি৷ ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক আলাউদ্দিন, ঝিনাইদহে স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক মীর ইলিয়াছ হোসেন দিলীপ, খুলনার ডুমুরিয়ায় নহর আলী ও শুকুর সরদার, ২০০৪ সালে খুলনা প্রেসক্লাব সভাপতি ও দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু (হুমায়ুন কবির বালুর হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে) ও দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো চীফ মানিক সাহা খুন হন৷ একই বছরে হত্যা করা হয় দৈনিক সংগ্রামের খুলনার ব্যুরো চীফ বেলাল হোসেনকে৷ ২০০২ সালে খুন হন খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সিনিয়র রিপোর্টার হারুন অর রশিদ (হারুন অর রশিদ হত্যা মামলারও সব আসামি খালাস পেয়েছে)৷ ২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর অফিসে ঢুকে বিশেষ প্রতিনিধি শামসুর রহমানকে হত্যা করা হয়৷ ২০১০ সালে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান মিঠু ও ২০১২সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতিকে৷
আশংকার কথা হলো, উৎপল দাসের ঘটনা নিয়েও এখনও পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারছে না আইনশৃংখলা বাহিনী৷
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা এই ঘটনার তদন্ত করবেন, তাদের ওপর কিন্তু চাপ অব্যাহত আছে৷ পুলিশও চেষ্টা করছেন কিন্তু এখনও কোনো ‘ক্লু' পাচ্ছেন না বলে আমাদের জানিয়েছন৷''
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে তিনি নিজে কী ভূমিকা রাখছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘‘আইন শৃংখলাবাহিনীকে একটা চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে, তারা যেন একটা হদিস বের করতে পারেন৷ কারণ, একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাবে, এটা তো মেনে নেয়া যায় না৷''
তিনি স্বীকার করেন যে, এ ধরনের ঘটনায় যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সেটি সরকারের জন্য সুখকর নয়৷ সেই হিসেবে সরকার কিন্তু উদ্বেগে আছে এবং সরকারের তরফ থেকেও আইন-শৃংখলাবাহিনীকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যেন এটার দ্রুত হদিস বের করা হয়৷''
‘‘ঘটনা একটা ঘটেছে, এটা হলো বাস্তবতা৷ এই ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে, এর প্রশমন হওযা দরকার৷ যাঁদের পেশা সাংবাদিকতা, তাঁরা যদি নিরাপত্তাহীনতা বা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, তাহলে সেখানে কিন্তু সাহসী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়৷''
সরকার আইন-শৃ্ঙ্খলাবাহিনীকে পরামর্শ দেয়ার পরও এখনও কোনো খবর নেই পুলিশের কাছে৷ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে পুলিশের একাধিক কর্তা ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হয়৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড প্লানিংয়ের ডিআইজি মো. মহসিন হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই৷ মিডিয়া ছাড়াও পুলিশের অনেক বিভাগ আছে, গোয়েন্দা, এসবি, অপারেশন্স আছে- এদের কারও কাছে আপনি পেতে পারেন৷''
অন্যদিকে, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘‘আমি সাধারণত কোনো বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দেয়ার দরকার থাকলে, সাংবাদিকরা খুব ধরলে, তখন কথা বলে থাকি, তাছাড়া আমাদের মিডিয়া বিভাগই কথা বলে৷ এই ব্যপারটি নিয়ে আমার কোনো খবর জানা নেই৷ আমি কিছু স্টাডিও করিনি৷ কাজেই এ নিয়ে আমাকে আর প্রশ্ন না করলেই ভালো হয়৷''