সাংবাদিকতায় খবর আছে!
৮ নভেম্বর ২০১৯সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার মূল্য দেয়া যাচ্ছে না৷ সাংবাদিকেরা কেবল কর্মচারী৷ আর সম্পাদকেরা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা৷ বছরের শুরুতে এডিটরস গিল্ডের এক আয়োজনে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের পরিস্থিতি কিছুটা এভাবে তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান৷ প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) বর্তমান চেয়ারম্যানের কথায় এসেছে মুদ্রার এক পিঠ৷ যেখানে সাংবাদিকতার গুণগতমানের জায়গায় ছাড় দেয়ার প্রবণতার কথা বলা হয়েছে৷ মুদ্রার অন্য পিঠ তথা জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে নীতির প্রশ্নে আপোষের যে ইঙ্গিত- তার সুফল মিলছে কি? মোটেই না৷ কেননা দেশের গণমাধ্যমে কোথাও আছে ছাঁটাই আতঙ্ক৷ কোথাও আছে বেতনভাতার অনিশ্চয়তা৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে পরিস্থিতি বিশদে জানালেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি ইলিয়াস হোসেন৷
তার ভাষায়, ‘‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে৷ বিশেষ করে বেতনভাতার যে বিষয়টা, যেটি পত্রিকা বা টেলিভিশনে একই রকম অবস্থা৷ অনেক জায়গাতেই কয়েক মাসের বেতন জমা পড়ে আছে৷ আমরা যারা সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করি, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলেছি৷ সব কর্তৃপক্ষের কথা প্রায় একই, তাদের রেভিনিউ কম, আয় হচ্ছে না৷ তারা বেতন দেবে কোথা থেকে? এ কারণেই মূলত তারা দিতে পারছে না৷''
গণমাধ্যমের আয়ের প্রধানতম উৎস বিজ্ঞাপন৷ এই বিজ্ঞাপন কী কমে গেছে? এ প্রসঙ্গে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত এই সাংবাদিক বলেন, ‘‘এখানে যে পদ্ধতিতে দর্শকেরা টেলিভিশন দেখে সেক্ষেত্রে টিভি কর্তৃপক্ষ দর্শকের কাছ থেকে সরাসরি কিছু পায় না৷ আয় শুধুই বিজ্ঞাপন নির্ভর৷ বর্তমানে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ভারতের টিভি চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে৷ এখানে বিজ্ঞাপনের নিয়মিত বিলও পরিশোধ করা হয় না৷ অনেক টেলিভিশনের মার্কেটিং বিভাগের কথা জানি৷ তারা দিনের পর দিন ধর্ণা দিচ্ছে৷ তারপরও তারা টাকা তুলতে পারছে না৷''
আয়-রোজগারের দিক থেকে সাংবাদিকেরা পিছিয়ে আছে৷ এটা অনেকেরই জানা৷ তবে শখ থেকে নেশা, নেশা থেকে পেশা- এমন পাইপলাইন থেকেই গণমাধ্যমে আসছে তরুণেরা৷ তাদের জন্য কেমন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে- এমন প্রশ্নে ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমিও ব্যাক্তিগতভাবে সাংঘাতিক দ্বিধান্বিত৷ এই পেশায় টিকে থাকা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই কঠিন৷ এখানে নতুন করে যারা সাংবাদিকতায় আসতে চাইবে, আসলে হতাশার কথা বলতে ভালো লাগে না তবে যে সময় চলছে এখন যারা কাজ করছে তাদেরই ঠিকমত বেতন হচ্ছে না৷ এই আশঙ্কায় নতুনদের জন্য এই ক্ষেত্রটি খুবই ঝুকিপূর্ণ৷''
সংকট উত্তরণে গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের রুটিরুজি ও অধিকার নিয়ে কাজ করার কথা মূলত ট্রেড ইউনিয়নের৷ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন- এগুলো আবার দুইভাগে বিভক্ত৷ এটাও খুবই দুঃখজনক যে নব্বইয়ের পর থেকেই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির একটা ব্যাপার চলে আসছে৷ ফলে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট বা সমর্থক যারা তারাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ পেয়ে থাকে৷ তারা অনেক সময়ই সরকারের সঙ্গে বা মালিক পক্ষের সঙ্গে যে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের জন্য যতটুকু শক্তি দরকার সেটা দেখাতে পারে না৷ আর যারা বিরোধী দলের সমর্থক, তাদের যে ট্রেড ইউনিয়ন তারা তো কোনো পাত্তাই পায় না৷''
প্রসারে প্রচার না অপপ্রচার?
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রসার হয়েছে৷ আসলেই তো সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও আর অনলাইন মাধ্যম সংখ্যায় এতো বেড়েছে যে, এগুলোর হিসেব রাখাই দায়৷ আর নানান নামে, নানান আকারে, নানান দিনের ছাপানো পত্রিকা তো আছেই৷ এগুলোর সঙ্গে তালমিলিয়ে বেড়েছে গণমাধ্যম কর্মীর সংখ্যাও৷ মেধা-মননে, নীতি-নৈতিকতায় সবাই কি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন?
বাস্তব পরিস্থিতি ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগকে জানালেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত৷ তিনি বলছেন, ‘‘একসঙ্গে অনেক মিডিয়ার বিকাশ ঘটছে৷ তারমধ্যে অনলাইন, টেলিভিশন, পত্রিকা৷ সবমিলিয়েই প্রশিক্ষিত সাংবাদিকের এক ধরনের অভাবতৈরি হয়েছে৷ এ কারণে অনেকে খুব দ্রুতই দায়িত্বশীল পদে চলে যাচ্ছে৷ কিন্তু দায়িত্বশীলতার জায়গা একটা অভিজ্ঞতার বিষয়৷ সেটি কিন্তু হচ্ছে না৷ যে কারণে সাংবাদিকতার বেসিক যে ন্যায়নীতি অনুসরণ করা- সেটি অনেক সময় হয় না৷ এছাড়াও সংবাদ ভুলভাবে পড়া, যথাযথ নিয়ম অনুসারে না করা- এগুলো এখন অহরহ ঘটছে৷''
গণমাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সামনে রেখে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিভাগ খুলেছে সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়৷ আলাদা করে রয়েছে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান৷ এ বিষয়ে এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ‘‘খুব ভালো প্রশিক্ষণের কিছু জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট আছে৷ সেখানে সাংবাদিকতার বেসিক কিছু জিনিস পড়ায়৷ কিন্তু হাতে কলমে শেখানোর যে বিষয়টা সেটা কিন্তু হয় না৷ বিশ্বের অনেক দেশে সে ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু বাংলাদেশে নেই৷ যে কারণে হাতে কলমের ট্রেনিংটা হচ্ছে না৷ আর এমনিতেই প্রশিক্ষিত সাংবাদিকের খুব অভাব৷ ফলে খুব দ্রুত এই ট্রেনিংয়ের দিকে নজর দেওয়া যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশে আমার মনে হয় না ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটায় অতো গুরুত্ব দেওয়া হয়৷''
পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীর সংকট কাটাতে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে শ্যামল দত্ত বলছেন, ‘‘সংগঠনগুলোর তো ভূমিকা রাখার কথা৷ কিন্তু সংগঠনগুলো কোনো ভূমিকা রাখছে না৷ তাদের কোনো পেশাদারি নেই৷ তারা নিজেদের পেশার উন্নয়নে কোনো গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে না৷ তারা বরং ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক কর্মকাণ্ডে বেশি আগ্রহী৷ অথচ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উন্নয়নে বড় বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ প্রেস ইন্সটিটিউট রয়েছে, প্রেস কাউন্সিল রয়েছে- এরা চাইলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত৷ কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তারা ভূমিকা রাখছে না বা রাখতে পারছে না৷ তারা সাংবাদিকদের ট্রেনিং দিতে পারে৷ এটা প্রেস কাউন্সিল করতে পারে৷ তারপর পিআইবিও আছে৷ আমি নিজেও পিআইবির গভর্ণিং বডির একজন সদস্য৷ আমি দেখি সেখানে তথাকথিত যে ট্রেনিং- এর বাইরে কিছু হচ্ছে না৷ আধুনিক সাংবাদিকতার সঙ্গে মিলিয়ে আধুনিকায়নের কাজ করা হচ্ছে না৷ এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়৷''
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷