আগুনের ঘটনা তদন্ত করবে বিচারিক হাকিম
১৪ ডিসেম্বর ২০১৬সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার একটি ভিডিও নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হওয়ার পর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি সম্পূরক আবেদনে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চ বুধবার এই আদেশ দেয়৷ পাশাপাশি উচ্ছেদের সময় ভাঙচুর, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা একটি এজাহার ও একটি জিডি মামলা হিসেবে নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে বলে হাইকোর্ট৷ পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ন্যূনতম পুলিশ সুপার মর্যাদার কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে এই তদন্ত তদারকের ব্যবস্থা করতেও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দেয় আদালত৷
বুধবার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষ থেকে একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়, যেখানে পুলিশের আগুন দেওয়ার ঘটনা তদন্তের নির্দেশনা চাওয়া হয়৷ আসক-এর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট আবু ওবায়দুর রহমান৷ এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত দুই সাঁওতালের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু৷
অ্যাডভোকেট আবু ওবায়দুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছে পুলিশ৷ আর সেটাই আমরা আদালতের নজরে আনি৷ আদালত গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে৷ পাশাপাশি সাঁওতালদের একজন থানায় এসে যে এজাহার দিয়েছিলেন, সেটিও পুলিশ জিডি হিসেবে রেকর্ড করেছে৷ আমরা সেটা মামলা হিসেবে রেকর্ড করার আবেদনও করেছিলাম৷ আদালত সেটিকে মামলার সমান ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন৷’’
গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে৷ সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়৷ সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়৷ ঐ ঘটনায় নিহত হন তিনজন সাঁওতাল, আহত হন আরো অনেকে৷ সংর্ঘষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ মামলায় চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করার পর, তাঁরা জামিনে মুক্তি পান৷ অন্যদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মরমুর ছেলে স্বপন মুরমু গত ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ তাঁর মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ দশদিন পর গত ২৬ নভেম্বর সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেম্ররম বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ দাখিল করেন৷ আগে একটি মামলা থাকায় পুলিশ তাঁর অভিযোগ এজাহার হিসেবে না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নথিভুক্ত করে৷ হাইকোর্ট বুধবারের আদেশে বলে, দু'টি অভিযোগই এজাহার হিসেবে নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে৷
এদিকে উচ্ছেদের সময় গুলিতে আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডোর স্ত্রী অলিভিয়া হেম্ররম এবং গণেশ মুরমুর স্ত্রী রুমিলা কিসকুর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ২১ নভেম্বর হাইকোর্টে আরেকটি রিট আবেদন করেন৷ সেখানে সাঁওতালদের ওপর ‘হামলার ঘটনা' তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়. পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে রুল দেয় আদালত৷ সাঁওতালদের উচ্ছেদের নামে তাদের মারধর, লুটপাট, গুলি ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং উচ্ছেদের নামে ওইসব কর্মকাণ্ড কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়৷ দু'টি রুলের শুনানি চলাকালে গত ৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধার জেলা প্রশাসককে তলব করে হাইকোর্ট৷
এদিকে ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷ ঐ ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়ছেন৷ কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন৷ পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে থাকা আরেকজন আগুন অন্য ঘরে ছড়িয়ে দিতেও সহায়তা করেন৷ ভিডিওর একটি অংশে আরও কয়েকটি ঘরে আগুন দিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের৷ তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, একজনের পোশাকের পিঠে ডিবি, আরেকজনের পুলিশ লেখা ছিল৷
পুলিশ আগুন দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান মঙ্গলবার মাদারীপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের অগ্নিসংযোগের বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে৷ তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে৷
অপরদিকে মামলার প্রেক্ষাপট বর্ণণা করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাঁওতালরা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নতুন নতুন তথ্য আমাদের সামনে আসছে৷ আমরা শুরু থেকেই নির্যাতিত সাঁওতালদের পাশে দাঁড়িয়েছি৷ এবারও যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখলাম পুলিশ সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছে, তখন বিষয়টি আদালতের নজরে আনি আমরা৷ এরপর তো আদালত গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনার কিছু বলতে চাইলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷