‘সমাজে নৈতিকতা না থাকলে সাংবাদিকদের উপরও তার প্রভাব পড়ে'
২৪ জুলাই ২০২০ডয়চে ভেলে : অপরাধবিষয়ক সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা কতটা নৈতিকতা মেনে চলেন?
তৌফিক ইমরোজ খালিদী : দেখুন সাংবাদিকরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন৷ সমাজেরই অংশ৷ রাষ্ট্র এবং সমাজে যদি নীতি-নৈতিকতার অনুশীলন যথাযথভাবে না থাকে, আইনের শাসন যদি না থাকে, তাহলে এই বিষয়গুলো কঠিন হয়ে যায়৷ সাংবাদিকরা যেহেতু সমাজেরই অন্য অংশ থেকে এসেছেন, তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, একই জায়গায় বড় হয়েছেন, কেউ সাংবাদিকতায় এসেছেন কেউ অন্য জায়গায় গেছেন৷ তারা হঠাৎ করেই কিন্তু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যান না৷ তাদের কাছ থেকেই শুধু নীতি-নৈতিকতা আপনি আশা করতে পারেন না৷ যদি সমাজের বাকি অংশে নীতি-নৈতিকতার অনুশীলন না থাকে, আইনের শাসন না থাকে৷ এটা আইনের শাসনের সাথে সম্পর্কিত৷ আইন এবং আইনের শাসন, গণতন্ত্র, শিক্ষা কতগুলো মৌলিক বিষয় আছে, সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত৷ শিক্ষার মান যদি খুব খারাপ থাকে, তাহলে মানুষকে শেখাবেন কিভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যদি খুব খারাপ থাকে, আপনি কী করে মানুষকে শিখাবেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক না, এই কাজটি করা উচিত, এই কাজটি করা উচিত না? কোনো না কোনো পর্যায়ে মানুষকে শিখতে হবে৷ যারা সাংবাদিকতায় এসেছেন, এখানে আসার পরে কিছুটা শেখানোর চেষ্টা হয়৷ সেই চেষ্টা থেকে কেউ কেউ নীতি-নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতা করেন৷ কিন্তু তারা ধীরে ধীরে এদেশে এতটাই সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে, এতটাই সংখ্যায় কম হয়ে যাচ্ছে যে, এখানে কাজ করাই একটা সংকটের হয়ে যাচ্ছে৷
মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকরা কাজ করতে গিয়ে যে নৈতিকতার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি তারা খেয়াল করেন?
দেখুন, মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা তো বিচ্ছিন্ন নন৷ এক অর্থে কিন্তু কেন্দ্রে যারা কাজ করেন, মূলত বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ঢাকাভিত্তিক এবং বড় সংবাদমাধ্যম সবই ঢাকাকেন্দ্রিক৷ ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ এখান থেকেই পরামর্শ বা নির্দেশ দেয়া হয়৷ ঢাকায় যারা নিয়ন্ত্রনকারীর ভূমিকায় আছেন, তারা কী চান সেটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে৷ আপনি তো দোষটা তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না৷ আপনি যদি তাদের কাছ থেকে ভালো কাজ চান তাহলে সেটা সম্ভব৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি৷ এখন কথা হলো, আপনি যদি তাদের একদম ছেড়ে দেন, তাহলে তো হবে না৷ তাদেরকে কিছু গাইডলাইন দিতে হবে, কিছু নির্দেশাবলী দিতে হবে যে, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না৷ মৌখিকভাবে হোক, লিখিতভাবে হোক, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবেই হোক. সেটা থাকতে হবে৷ বার্তাকক্ষের সঙ্গে তারা যখন যোগাযোগ রাখেন, তখন তাদের এই বার্তাটা যদি ঠিকমতো দিয়ে দেয়া যায় যে, আপনাদের কাজগুলো এইভাবে করতে হবে, এটা মানতে হবে৷ একজন ব্লগার যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারেন, কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন না৷ একটা ব্লগসাইট এবং পেশাদার সাংবাদিকদের দিয়ে চালানো একটি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷ সংবাদমাধ্যম তো এখন বলা যায় অনেকটাই ইন্টারনেটনির্ভর৷ সেটা টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও৷ পত্রিকাগুলো এখন আর কত কপি ছাপা হয়? এত কমে গেছে যে, প্রচারসংখ্যা হাস্যকর পর্যায়ে চলে গেছে৷ যাদের এক সময় আমরা বড় কাগজ বলে মনে করতাম বা বিশ্বাস করতাম, তাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে৷ সেই দিক হিসাব করলে সবাই এখন ইন্টারনেটনির্ভর৷ যে কেউ ইচ্ছা করলেই এখন ১০ ডলার খরচ করে একটি ডোমেইন কিনে একটি সাইট চালু করে দিতে পারেন৷ তারপরও কিন্তু সবাই সব সাইটে যাচ্ছেন না৷ যাদেরকে বিশ্বাস করেন, সেই সব সাইটেই মানুষ যাচ্ছেন৷ হয়ত কিছু চটুল খবর দিয়ে, ঠিক যেগুলো খবর হিসেবে চলে না সেগুলো দিয়ে অনেকে তাদের রেটিং বাড়িয়ে নেন, তাদের পাঠকসংখ্যা বাড়িয়ে নেন কাগজে-কলমে, কিন্তু ভালো সংবাদের জন্য মানুষ বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমেই যান৷ যেসব প্রতিনিধি আছেন, তাদেরকে আমাদের কিছু একটা বলে দিতে হবে৷ এইভাবে কাজগুলো করতে হবে, এই হলে স্টোরি যাবে, আর এই না হলে যাবে না৷
নাম না জানা লোকের সূত্র দিয়ে আপনি বিশাল অভিযোগ লিখে দিবেন সেটা হবে না৷ সবকিছু নির্ভর করছে আসলে যারা সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দেন, তাদের উপর৷ বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দেন, মানে ইউনিয়নের নেতাদের কথা আমি বলছি না, সম্পাদকীয় নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন, তাদের কথা বলছি৷ সাংবাদিক নেতাদের যোগ্যতা কতটুকু? তারা কতটা সিরিয়াস এ ব্যাপারে? তাদের কতটুকু জ্ঞান আছে বা যোগ্যতা আছে সেটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে৷
সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভিকটিম প্রোটেকশন বলে যে বিষয়টা আছে ,সেটা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
অবশ্যই জরুরি৷ আইনে ভিকটিম প্রটেকশনের অনেক কিছু আছে৷ আইনের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক আছে৷ অনেক দীর্ঘ আলোচনা এটা নিয়ে হতে পারে৷ আমরা সেদিকে না যাই৷ সমস্যাটা হচ্ছে, আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, সেই সুযোগটা নিয়ে অনেকে মনে করেন, ‘আমি গণমাধ্যমে কাজ করি, যা ইচ্ছে তাই করতে পারি৷' কিন্তু আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না৷ আমিও কিন্তু দায়বদ্ধ আমার পাঠকের কাছে, দর্শকের কাছে৷ কাজেই এই দায়বদ্ধতা থেকেই কাজ করতে হবে৷ আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে, আপনারও দায়বদ্ধতা আছে, তাহলে আপনি উল্টোপাল্টা কাজ করবেন না৷
পত্রপত্রিকায় বিচারের আগেই সন্দেহভাজন আসামি ছবি ছাপা বা টিভিতে ভিডিও দেখানোর মাধ্যমে যে পাবলিক ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে, তাতে কি আপনি বিপন্ন বোধ করেন?
অবশ্যই৷ এটা অত্যন্ত খারাপ৷ আমি নিজেই তো এগুলোর ভিক্টিম হই মাঝে মধ্যে৷ একেবারেই নাম না জানা ওয়েবসাইটে ছবি দিয়ে উদ্ভট সবকিছু লিখে দেয়৷ এগুলোর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে না, আমি কখনো প্রতিবাদ করিও না৷ সেদিন দেখলাম, এক জন ফলোয়ার আছে এমন একটি ব্লগে উদ্ভট কিছু মিথ্যা তথ্য লেখা হয়েছে৷ আমি শুধু নিজে যে শিকার হই তা নয়, অনেকেই এটার শিকার হন৷ কাজেই এগুলোর দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন আছে৷ আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের একটা বড় দুর্বলতা আছে৷ অনেক ক্ষেত্রেই অনেক আইন আছে কিন্তু সেসব আইনের প্রয়োগ নেই৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ আছে৷ যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কথা যদি বলা হয়, এই আইনের স্পিরিটটা নিয়ে কিন্তু কোনো সমস্যা নেই৷ যে লক্ষ্য নিয়ে বানানো হয়েছিল সেটা ঠিক আছে৷ কিন্তু আইনের মধ্যে এমন কিছু ধারা আছে, যেগুলো একেবারেই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ যেগুলো আসলে বাংলাদেশে বাস্তবায়নযোগ্য নয়৷ আমি নিজেও ভুক্তভোগী৷ আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে৷ তাই বলে কি আমরা দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করবো না? দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করি বলে আমাদের অনেক রকম ঝামেলা পোহাতে হয়৷ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে৷ ওই স্টোরিটা কি ছিল? একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে৷ সেখানে প্রটেকশন আছে৷ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হতেই থাকবে৷ আমাদের এগুলো নিয়েই বাঁচতে হবে৷ সেই সঙ্গে শিখতে হবে যে, এরকম পরিস্থিতিতে বা এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে কিভাবে বাঁচা সম্ভব? খেয়াল রাখতে হবে আমাদের কাজের কারণে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়৷ তাহলে এই পেশা বিপন্ন হবে, মানুষের শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যাবে, মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে৷
সাংবাদিকরা এই ধরনের পাবলিক ট্রায়ালে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন? সে বিষয়ে আপনার কী মত?
এটা ঠিক নয়৷ অ্যাক্টিভিজম এবং জার্নালিজম দু'টো ভিন্ন জিনিস৷ অনেকেই এটা নিয়ে আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন না৷ আপনি আন্দোলন, সংগ্রাম, সমাবেশ করবেন, স্লোগান দেবেন, সেটা এক জিনিস৷ আবার সাংবাদিকতা করবেন, সেটা কিন্তু অন্য জিনিস৷ আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকতেই পারে৷ আপনার কারো কারো প্রতি পক্ষপাত থাকতেই পারে, কিন্তু সেটার প্রতিফলন কাজে যেন না হয়৷ আপনার কাজে এসবের কোনো প্রতিফলন কখনোই থাকতে পারবে না৷ অ্যাক্টিভিজম এবং জার্নালিজম এই সীমারেখাটা বা লাইন টেনে যদি স্পষ্ট করে টেনে দিতে না পারি, তাহলে একটা ঝামেলা থেকেই যাবে৷ আমার সহকর্মীদের আমি বলার চেষ্টা করি, আপনাকে মানুষের বিশ্বাস করতে হবে যে, আপনি কোনো পক্ষের লোক নন, আপনি নিরপেক্ষ লোক৷ সেটা জরুরি বিষয়৷ কারো একটা ফেসবুক পোস্ট বা কারো একটি টুইটারের ছোট্ট এক লাইনের একটা লেখায় যদি মনে হয় তিনি ওই পক্ষের লোক বা এর সমর্থক বা ওর সমর্থক নয়, এটা সমস্যা সৃষ্টি করে৷ তাই সাংবাদিকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি সামাজিক জীবনেও সতর্কভাবে চলার প্রয়োজন আছে৷
রিপোটিংয়ে চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অবজেক্টিভিটি থাকে না, বরং প্রতিবেদন সাবজেক্টিভ হয়ে যায়৷ এর কারণ কী?
সেই একই কথা৷ সম্পাদকীয় নেতৃত্ব যে বা যারা দেন, সেখানে বার্তা সম্পাদক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ সম্পাদক, প্রধান সম্পাদক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ তারা একটা মান নির্ধারণ করে দেবেন যে, এই মানের নীচে হলে আমি রিপোর্ট ছাড়বো না৷ সেটি যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে সমস্যা থাকবে৷ মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা বা সংবাদ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার যোগ্যতা সম্পাদকের থাকতে হবে৷ যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার সেই শিক্ষা থাকতে হবে৷ তার সেই অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা না থাকলে সমস্যাটা দেখা দেয়৷
বিচারহীনতার সংস্কৃতি কি গণমাধ্যমকর্মীদের উপর প্রভাব ফেলছে?
যে সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যে সমাজে মানুষ অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, সেখানেই সমস্যা দেখা দেয়৷ সেখানে শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে না, সমস্ত কিছুতেই সমস্যা দেখা দেয়৷ সেখানে দুর্নীতি হয়, সরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি হয়, সেখানে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিয়ম হয়, কাজেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি শুধু সাংবাদিকতার জন্য নয়, সমাজের জন্য, পুরো রাষ্ট্রের জন্য খারাপ৷