‘সমন্বিত বেতন-কাঠামো’
২২ এপ্রিল ২০১৩বেসরকারি চ্যানেলগুলোর মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ কারণে টেলিভিশন সাংবাদিকতা বাংলাদেশে খুব অল্প সময়ে অনেক এগিয়েছে৷ কিন্তু সাংবাদিকতা বিশেষত্ব পায় অনুসন্ধানী বা বিশেষ প্রতিবেদনে, নইলে যা দাঁড়ায় তাকে বাগাড়ম্বরপূর্ণ গতানুগতিকতার ঊর্ধে স্থান দেয়া কঠিন৷ আজকাল সত্যিকার অর্থে ‘বিশেষ প্রতিবেদন' খুব একটা দেখা যায়না, দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, এমনকি অনলাইনেও নাকি পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যে একই প্রতিবেদন করার প্রবণতা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে? বিষয়টি অস্বীকার করেননি প্রভাষ, তবে এরও মূল কারণ হিসেবে জানালেন আর্থিক সংকটের কথা, ‘‘হ্যাঁ, এটা অনেকাংশেই ঠিক৷ আর এ জন্য আন্তরিকতার চেয়ে সীমাবদ্ধতাই বেশি দায়ী৷ অনেক প্রতিষ্ঠানই অনুসন্ধানী বিশেষ প্রতিবেদন করতে চায়, কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় পেরে ওঠে না৷ বাংলাদেশে বর্তমানে দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কারোই বিশেষ প্রতিবেদন করানোর সামর্থ্য নেই৷ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করানোর জন্য চাই আলাদা টিম৷ যেমন ধরুন, কোনো টিভি চ্যানেল যদি একজন বা দু'জন রিপোর্টারকে এক মাসের জন্য ছেড়ে দেয়, তাহলে হয়ত একটি বা দুটি ভালো প্রতিবেদন হতো৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের একজন রিপোর্টারকে দিনে একাধিক রিপোর্ট করতে হয়৷ বিটিভি ছাড়া আমাদের অন্য কোনো টিভি চ্যানেলেরই আর্থিক সামর্থ্য, লোকবল অনুসন্ধানী রিপোর্ট করানোর মতো পর্যাপ্ত নয়৷ বাড়তি লোক নেওয়ার সামর্থ্যও থাকে না৷ তারপরও সীমিত সামর্থ্যেই অনেকগুলো টিভি চ্যানেল ভালো রিপোর্ট করার চেষ্টা করে৷ ঢাকার বাইরে টিম পাঠিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করে৷ অন্যদের কথা ভালো জানি না, আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেই এটিএন নিউজে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবারে একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর একাধিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়৷ তবে এটা পর্যাপ্ত নয়৷ প্রত্যেক টিভি চ্যানেলেরই সামর্থ্য বাড়িয়ে বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য আলাদা টিম করা দরকার৷''
কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে টক-শো বেশ জনপ্রিয়তা৷ সহজে দর্শক টানার কৌশল হিসেবে বলতে গেলে সব চ্যানেলই টক-শো প্রচার করে৷ এমন অনুষ্ঠান নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক৷ বিষয় নির্বাচন, বক্তা বা আলোচকদের হাস্যকর বাচনভঙ্গী, ভুলভাল উচ্চারণ, বিতর্কিত এবং অননুকরণীয় ব্যক্তিদের আলোচকের মর্যাদা দেয়া – তালিকা করলে সেটাই বোধহয় গড়পড়তা টক-শোগুলোর মতো দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর হয়ে যাবে৷ প্রভাষও মানেন টক-শো ক্রমাগত আকর্ষণ হারাচ্ছে, ‘‘দর্শকপ্রিয়তার কারণে অধিকাংশ টিভি চ্যানেলই এক বা একাধিক টক-শো করে এটা ঠিক৷ তার মানে প্রতিদিন বাংলাদেশে অন্তত ৩০টি টক-শো প্রচারিত হয়৷ সংখ্যাধিক্যই মান পড়ে যাওয়ার মূল কারণ বলে আমার ধারণা৷ প্রতিদিন টক-শোর জন্য অতিথি পাওয়াই দুষ্কর৷ দর্শক রাজনীতির কথা শুনতে পছন্দ করেন বলে প্রতিদিন রাজনীতি নিয়েই আলোচনা হয়৷ তবে দর্শকপ্রিয়তার সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেলিভিশনগুলো টক-শোর মাধ্যমে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার আয়োজন করতে পারে, প্রতিদিন একই মুখ দেখতে দেখতে ক্লান্ত দর্শকদের জন্য নতুন মুখ খুঁজে বের করতে পারে৷ ভালোভাবে কথা বলতে পারেন, এমন লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে কিন্তু খুব কম নয়৷''
চ্যানেলগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য টাকা দরকার৷ সেই টাকার মূল জোগান আসে বিজ্ঞাপন থেকে৷ তাই বলে খবর এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানের আগে-পরে যে হারে বিজ্ঞাপন দেখানো হয় তা কি ঠিক? দর্শক-শ্রোতারা কি বিরক্ত হননা? অনেক দেশে তো বিরক্ত হয়ে দর্শক মামলা ঠুকে, ক্ষতিপূরণও আদায় করে নেন৷ তো অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে কি চ্যানেলগুলো সরে আসতে পারেনা? জবাবে একটি বিকল্পের কথা বলেছেন প্রভাষ, তবে সেই বিকল্প পথে টিভি চ্যানেলগুলো খুব তাড়াতাড়ি এগোবে তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ৷ প্রভাষ বললেন, ‘‘দর্শক হিসেবে টিভি দেখতে বসলে আমিও বিরক্ত হই৷ কিন্তু যখন অফিসে বসি তখন বুঝি, বিজ্ঞাপন ছাড়া টেলিভিশনগুলোর চলা দায়৷ বাংলাদেশে টেলিভিশনগুলোর আয়ের একমাত্র উত্স বিজ্ঞাপন৷ প্রতিদিন টেলিভিশন চালাতে যে খরচ তা উঠে না এলে মালিকদের সাবসিডি দিতে হয়৷ তারা তা দিতে চান না৷ তাই টেলিভিশনগুলোর বিজ্ঞাপন নির্ভরতা সর্বগ্রাসী৷ ইদানীং টেলিভিশনের সংখ্যায় বান ডাকার পর এই নির্ভরতা আরো বেড়েছে৷ টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও বিজ্ঞাপনের বাজার তো অত বড় হয়নি৷ ফলে টেলিভিশনগুলোকে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে নতজানু হয়ে টিকে থাকতে হয়৷ তাছাড়া প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনের রেট কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে৷ আসলে বাংলাদেশের টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় অনেকটা পানির দরে৷ তাই অনেক বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করেও টিভিগুলো তাদের খরচ তুলে আনতে পারে না৷ কেউ রেট বাড়াতে চাইলে বিজ্ঞাপনদাতারা অন্য টিভিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেন৷ এ এক সাংঘাতিক অশুভ চক্র৷ রেট কমালে বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু দেখার থাকে না, সারাদিন বিজ্ঞাপন চালানোর পর খরচও ওঠে না৷ সবগুলো চ্যানেলের মালিক যদি এক সাথে বসে বিজ্ঞাপনের রেট এবং এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ কত মিনিট বিজ্ঞাপন চালাবেন তা ঠিক করে নেন, তাহলেই কেবল এই চক্র ভাঙা সম্ভব৷''
বিটিভির গ্রহণযোগ্যতা নেই, তারপরও সেখানে শিক্ষামূলক এবং সচেতনতা বাড়ানোর মতো অনুষ্ঠান থাকে৷ বেসরকারি চ্যানেলগুলো কি এ ধরণের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদাসীন? যু্দ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, কুসংস্কার, যাকে তাঁকে নাস্তিক বলে দেয়া সম্পর্কে ইসলাম কী বলে – এমন বিষয়গুলোতে চ্যানেলগুলোর কোনো উল্লেখ করার মতো কাজ আছে? দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে কাজ করার পর টেলিভিশন সাংবাদিকতাতেও প্রতিষ্ঠিত প্রভাষে কথায়, ‘‘বেসরকারি চ্যানেলগুলো সেরকম অনুষ্ঠানই বেশি প্রচার করে যেগুলো দর্শক পছন্দ করবে, বিজ্ঞাপনদাতারা পছন্দ করবে৷ সমাজ সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হলে বেসরকারি টিভিগুলোকে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে৷ সেই সামর্থ্য তাদের নেই৷ তবুও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান যে একেবারেই হয় না, তা নয়৷ বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদৈর বিচার, সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে নানা অনুষ্ঠান, টক-শো প্রায়শই হয়ে থাকে৷ তবে এ ধরণের অনুষ্ঠান আরো বাড়ানো উচিত৷''
বিটিভির দুরবস্থার পাশাপাশি বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অবস্থা বোঝার এই প্রয়াসে সমালোচনাযোগ্য আরো কিছু বিষয়ও হয়ত উঠে আসতে পারতো৷ তবে অনেক ক্ষেত্রেই মূল কারণ হিসেবে উঠে আসবে টাকা৷ অনেকেই মনে করেন, বিটিভিতে চাকরির নিশ্চয়তা আছে বলে সবার কাজেই সরকারি অফিস-আদালতের মতো ঢিলেঢালা ভাব, চাকরি বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো দায় আছে বলে মনে করেন না বলে দায়িত্ব পালনেও সবাই খুবই উদাসীন৷ সেই তুলনায় বেসরকারি চ্যানেলের সাংবাদিক এবং কলাকুশলীদের কর্মস্পৃহার প্রশংসা করতেই হবে৷ চাকরির নিরাপত্তা দূরের কথা, জীবনের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়ে অনেক সময়৷ প্রভাষ যেদিন সাক্ষাৎকার দিলেন সেদিনই বিরোধী দলের হরতালে পোড়ানো হয়েছে এটিএন নিউজের গাড়ি৷ তার পরপরই হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পেটানো হয়েছে সাংবাদিকদের৷ এত ঝুঁকির মধ্যেও যাঁরা দায়িত্ব পালনে মরিয়া, তাঁদের এখনো কোনো নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই৷ প্রভাষ আমিন মনে করেন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও সংবাদপত্রের মতো একটা সমন্বিত বেতন কাঠামো জরুরি ভিত্তিতেই করা দরকার, ‘‘পত্রিকার জন্য সরকার ঘোষিত ওয়েজবোর্ড থাকলেও বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে কোনো বেতন কাঠামো নেই৷ এটা থাকা উচিত৷ কোনো কাঠামো না থাকায় এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে৷ এক টিভি থেকে আরেক টিভিতে লোক ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে৷ বিশেষ করে নতুনরা অল্প কিছুদিন ‘ছোট' স্টেশনে কাজ করে একটু কাজ শিখেই বেশি বেতনে চলে যান বড় স্টেশনে৷ এক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন কিছু করার থাকে না৷ পত্রিকার মতো টিভির জন্যও একটা বেতন কাঠামো থাকা দরকার৷''
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে সাংবাদিকদের সব সংগঠন এক হয়েছিল৷ কিন্তু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর থেকে সাংবাদিক নেতৃত্ব আবারও দ্বিধাবিভক্ত৷ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সাংবাদিকরা সমন্বিত বেতন কাঠামোর দাবি জানাতে চাইলেও, দাবি আদায়ের মিছিলে নেতৃত্ব দেবে কে?
সাক্ষাৎকার: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ