সংবাদমাধ্যম, বিচার বিভাগ এবং বঙ্গবন্ধু
১৪ আগস্ট ২০১৫সংবাদপত্রকে বলা হতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ এখন সংবাদপত্রের জায়গায় এসেছে গোটা সংবাদমাধ্যম, অর্থাৎ সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে রেডিও, টেলিভিনশ এবং অনলাইন৷ বাংলাদেশেও গত এক দশকে সংবাদমাধ্যম জগতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে৷ দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে নিবন্ধিত টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৪২, যদিও এর মধ্যে সম্প্রচারে আছে মাত্র ২৮টি৷ সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতারের বাইরে আছে ১২টি এফএম রেডিও৷ দেশে কমিউনিটি রেডিও আছে ২৮টি৷ বাংলাদেশে এখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা দু'শরও বেশি৷ সাপ্তাহিক পত্রিকা কম-বেশি এক হাজার ৮শ'৷ এছাড়াও আছে কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারের সময়ই গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে৷ বাংলাদেশে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের অনুমতি দেয়ার দাবিদারও তাঁর সরকার৷
ইতিহাসের পাতায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য৷ এর আগে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন৷ চারটি সংবাদপত্র রেখে আর সমস্ত সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ভুঁইয়া অবশ্য এটাকে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ বলতে নারাজ৷ তিনি মনে করেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু তখনকার প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটি সমাজান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য৷ বাকশালও সেই কারণেই করেছিলেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘এটা সবার জানা উচিত যে, তখন যেসব গণমাধ্যম বন্ধ করা হয়েছিল তাঁর সাংবাদিক ও কর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন উন্নয়ন সহায়ক গণমাধ্যম৷'' তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে হয়ত তাঁর পূর্ণ পরিকল্পনা বিকশিত হতো৷''
তবে এখনকার প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতার মাত্রা কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ আদালত অবমাননার দায়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদাকসহ দু'জনকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দণ্ড দিয়েছে সম্প্রতি৷ দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে একই দিনে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ এর আগে একাধিকবার আদালত অবমাননার মামলায় প্রথম আলো-র সম্পাদ এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক নিশর্ত ক্ষমা চেয়ে এবং মুচলেকা দিয়ে দণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন৷
এগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক সফিউল আলম ভুঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংঘর্ষিক না বলে আমি বলতে চাই আদালত সংবাদমাধ্যম-এর ব্যাপারে আরেকটু উদারতা দেখাতে পারে৷ কারণ বিচার বিভাগ এবং সংবাদমাধ্যম উভয়ই গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে৷'' তাঁর কথায়, ‘‘আদালত অবমাননা বিষয়টি নিয়ে আরো খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন৷ এতে বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হবে৷ কারণ প্রধান বিচারপতি নিজেও বলেছেন, ‘‘আদালতের গঠনমূলক সমালোচনায় কোনো বাধা নেই৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সাধারণভাবে তিন কারণে আদালত অবমাননা হতে পারে৷ প্রথমত, কেউ বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করলে৷ দ্বিতীয়ত, বিচারক ও বিচার বিভাগ নিয়ে জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি করলে৷ এবং তৃতীয়ত, বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বা নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে – এমন কোনো কিছু করলে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তিগতভাবে কোনো বিচারকের ব্যাপারে তথ্য ভিত্তিক প্রতিবেদন করলে আদালত অবমাননা হয় বলে আমি মনে করি না৷''
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের যেমন খেয়াল রাখা উচিত যেন আদালত অবমাননা না হয়, তেমনি আদালতেরও খেয়াল রাখা উচিত যেন আদালত অবমাননার নামে প্রয়োজনীয় সত্য প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়৷''
অধাপক সফিউল আলম এবং হাফিজুর রহমান কার্জন উভয়ই মনে করেন, বিশ্বে সংবাদমাধমের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং নানা মাধ্যমে তা বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়েছে৷ প্রযুক্তিগত উন্নয়নও হয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো খুব বেশি এগোয়নি৷ এর জন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন জড়িত, তেমনি সংবাদমাধ্যমের দলীয় আচরণ এবং পেশাদারিত্বের অভাবও কম দায়ী নয়৷