সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার কম হয়নি৷ এমনকি ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় থেকেও যদি দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে৷ কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো স্থানীয় স্বার্থে৷
ভারতভাগের পরপরই
ভারত ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে৷ এর পরপর পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে৷ অনেকে বলে থাকেন যে, রাষ্ট্রীয় মদদে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে৷ ১৯৪৯ সালে কালশিরা ও নাচোলে চলে বর্বরতা৷ এরপর ১৯৫০ সালে বরিশাল, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ, পাকিস্তানি পুলিশ, আনসার বাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ চালায়৷
গুজব ছড়িয়ে হামলা
প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যা এখনো দেখা যায়৷ তেমনই এক ঘটনা ঘটে ১৯৬৪ সালে৷ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত হজরতবাল নামক তীর্থক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে – এই সংবাদ ছড়িয়ে পূর্ব-বাংলায় আবারো সংগঠিত হয় বাঙালি হিন্দু হত্যা৷ আবারো হাজারো হিন্দু ধর্মাবলম্বী পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান৷
স্বাধীনতা আন্দোলনে
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়৷ তারা হিন্দু অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে৷ একটি হিসেব বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা নেমে হয়েছে ২১ শতাংশ৷
বাবরি মসজিদের গুজব
ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশে৷ তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও৷ ১৯৯০ সালে হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে নির্মম নৃশংসতা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে৷ এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত থেকে থেকে পুরো বংলাদেশেই হিন্দুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন হয়৷
রাজনৈতিক হামলার শিকার
শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা অন্য স্থানীয় স্বার্থে নয়, রাজনৈতিক কারণেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ যেমন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নির্দিষ্টভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা হয়৷ এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতেও ব্যাপক হামলা হয়৷ এসব হামলার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় নয় লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান৷
নিস্তার পাননি অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা৷ এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দিত হয়৷ ২০১৬ সালে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সাঁওতালদের৷ এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন সাঁওতাল মারা যান ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়৷ এছাড়া পাহাড়ে প্রায়ই নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়৷
এখনো থেমে নেই
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ের পর হামলা করা হয় নোয়াখালীর অনেকগুলো হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়৷ অনেক মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া রংপুর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে পরিকল্পনা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়েছে৷ এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন সারা দেশের মানুষ৷
কত শতাংশ অবশিষ্ট?
কিছু হিসেবে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ ছিল সংখ্যালঘু৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে তা ২২ শতাংশ৷ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তা নেমে হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ৷ তবে সবশেষ ২০১৫ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসেব দেখিয়েছে, তাতে হিন্দু ধর্মের মানুষের সংখ্যা ২০১১ থেকে বেড়েছে৷ ২০১৫ সালে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছে বাংলাদেশে৷
শত্রু সম্পত্তি আইন
২০০৮ সালে অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতসহ আরো কয়েকজনের লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়৷ বইটির নাম, ‘Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property’৷ সেখানে লেখকরা বলেন, শত্রু সম্পত্তি আইনের ফলে ১৯৬৫-২০০৬ সময়কালে ১২ লাখ পরিবারের ৬০ লাখ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এ সময় তাঁরা ২৬ লাখ একর ভূমি হারিয়েছেন৷
হামলার বিচার হয় না
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইতিহাস দীর্ঘ৷ কিন্তু হামলার বিচার এবং দোষীদের শাস্তির নজির নেই বাংলাদেশে৷