সংকটে শৈলশহর দার্জিলিং!
২১ অক্টোবর ২০১৩অতীতে গরমের বা পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং গিয়ে বাঙালি পর্যটকদের আধিক্য দেখে ভুল হতো, কলকাতার শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাট মোড়ই দার্জিলিং এর ম্যালে এনে কেউ বসিয়ে দিয়েছে বুঝি৷ তাতে অনেকে বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ফুটত দার্জিলিং জেলার পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের৷ কারণ সারা বছরের উপার্জনের একটা বড় অংশ আসত ওই পর্যটকদের হাত ধরেই৷ যবে থেকে পাহাড়ে স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তবে থেকেই দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং সহ গোটা জেলার পর্যটনশিল্প ধাক্কা খেয়েছিল৷ যখন তখন বনধ ডেকে পাহাড় অচল করে দেওয়া, নানা ধরনের জবরদস্তি, এমনকি সরকারি পর্যটক আবাসে ভাঙচুর, আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও মানুষকে ভয় পাইয়ে পাহাড় থেকে বিমুখ করেছিল৷
সেই হঠকারিতা থেকে সাম্প্রতিক অতীতে অনেকটাই সরে এসেছিলেন পাহাড়ের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষজন, যারা বুঝেছিলেন যে নিজেদের জীবনধারণের জন্যও ব্যবসা-বাণিজ্য চালু থাকাটা জরুরি, দরকার পর্যটনের মরসুমকে নির্ঝঞ্ঝাট রাখা৷ দার্জিলিং জেলার ছোট-বড় হোটেলগুলোর মালিক, দোকানদার এবং পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের উপর চাপ তৈরি করেছিল বলে শোনা যায়৷ এর জেরে অন্তত পর্যটকদের পাহাড়ে যাতায়াত কিছুটা অবাধ ও ঝামেলামুক্ত হয়েছিল, কিছুটা হলেও ছন্দে ফিরেছিল দার্জিলিং এর পর্যটন৷
কিন্তু এই বছর গরমের ছুটির সময় থেকেই আবার অশান্ত হতে শুরু করে দার্জিলিং এর পরিস্থিতি৷ বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে, যে সময় পুজোর ছুটির জন্যে বুকিং করা হয় দার্জিলিং এর হোটেলগুলোতে, সেই সময় গন্ডগোল পাকিয়ে, লাগাতার ১২ দিনের বনধ ডেকে, জোর করে স্কুলগুলোকে বন্ধ করে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য করে এক আশঙ্কার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার জঙ্গি কর্মীরা৷ রাজ্য সরকারও তার পাল্টা হিসেবে পুরোনো ফৌজদারি মামলা খুঁচিয়ে তুলে বেশ কজন মোর্চা নেতাকে গ্রেপ্তার করায়৷ ফলে আবার পাহাড়ের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়৷
সেই আশঙ্কারই প্রভাব পড়ল এবারে দার্জিলিংয়ে৷ পুজোর ছুটিতে যত পর্যটক সাধারণত পাহাড়ে যান, তার ৮০ শতাংশও ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটের ভয়ে দার্জিলিং এর ধারেকাছে ঘেঁষলেন না৷ যেখানে বছরের এই সময়টা দার্জিলিংয়ে পিক ট্যুরিস্ট সিজন থাকে, কার্যত তিল ধারণ করার জায়গা থাকে না, সেখানে ফাঁকা পড়ে রইল হোটেল, ব্যাপক মার খেল ব্যবসা৷ এবং এই প্রথম দার্জিলিং এর ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্যেই সরব হতে দেখা গেল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, যারা গা-জোয়ারি করে পণবন্দি করে রেখেছে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় শৈলশহরকে৷
দার্জিলিং এর বিখ্যাত ম্যালের যে চার রাস্তার মোড়, তারই উপর কিউরিও-র দোকান এক ভদ্রলোকের৷ প্রায় হা-হুতাশ করছিলেন, পর্যটন মরসুমের জন্যে প্রায় ১৫ লাখ টাকার জিনিস তৈরি করে রেখেছিলেন, তার প্রায় কিছুই বিক্রি হয়নি৷ মোর্চা নেতাদের উপর দোষারোপ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রীতিমত৷ বললেন, আপনারা ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবেন, সাহস করে পাহাড়ে আসতে৷ আপনারা এলে আমরাও সাহস পাব দোকান খোলা রাখতে৷ কিছু কিনতে হবে না৷ আপনারা এসে আমাদের সঙ্গে একটু গল্প করলেও আমাদের ভাল লাগবে৷
ক্ষোভ গোপন করতে পারলেন না আর এক ভদ্রলোক৷ পেশায় ভাড়াটে গাড়ির চালক, শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং এর মধ্যে পর্যটকদের আনা-নেওয়ার কাজ করেন৷ জানালেন, বিজয়া দশমীর দিন খরচ করবেন বলে সারা বছর ধরে একটু একটু করে টাকা সরিয়ে রেখেছিলেন৷ মোর্চা নেতারা হঠাৎ ১০-১২ দিনের বনধ ডেকে দেওয়ায় সেই উৎসবের পুঁজি ভেঙে চাল-ডাল-তেল-নুনের রসদ কিনতে হয়েছে৷ ফলে দশমীর দিন যখন বাড়ির ছোটরা প্রণাম করতে আসছে, তখন তাঁর হাত একেবারে খালি৷
এমন এক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে আসছেন সভা করতে৷ আর কোথাও নয়, তিনি সভা করবেন দার্জিলিং এর ম্যালে দাঁড়িয়ে৷ পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের জনসমর্থনে ভাঙনের শব্দ মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই সমতলে বসেই পেয়েছেন৷