শুঁটকি পল্লির আনন্দ-বেদনা
বাংলাদেশে শুঁটকি পল্লিগুলোর অধিকাংশই কক্সবাজার জেলায়৷ সেখানে উৎপাদিত শুঁটকি দেশের চাহিদা মেটায়, বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হয়৷ শুঁটকি তৈরি ও বিক্রি আগে দরিদ্রদের হাতে থাকলেও এখন তা উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিকভাবে, বিশাল কলেবরে৷
শুঁটকিতে চলছে হাজারো মানুষ
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া এবং সদর উপজেলার নাজিরারটেক, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদিসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে শুঁটকি মহাল৷ এসব মহালে কাজ করেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ৷
কোন শুঁটকির চাহিদা কেমন
সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল নাজিরারটেকের ব্যবসায়ীরা জানান, সামুদ্রিক রূপচাঁদা, ছুরি লাক্কা, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, চিংড়ি এবং মিঠাপানির মাছের মধ্যে শোল, কাচকি, কুচো চিংড়ি, মলা ও বেলেসহ প্রায় ২০ ধরনের মাছের শুঁটকি হয়৷ এর মধ্যে লইট্যা, ছুরি লাক্কা, কোরালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ লাক্কা শুঁটকি ১২০০, রূপচাঁদা ১২৫০, লইট্যা ২৫০ থেকে ৩০০, ছুরি ৪০০ টাকা, কোরাল ৮০০ টাকা, কালো চান্দা ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়৷
সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা
বিভিন্ন শুঁটকি পল্লি ঘুরে দেখা যায়, একের পর এক মাছ ধরার ট্রলার গভীর সমুদ্র থেকে তীরে আসছে৷ সেখান থেকে পোয়া, সোনাপাতা, মধুফাইস্যা, রূপচাঁদা, পোটকা, শাপলাপাতা, চাপিলা, লইট্টা, চিংড়ি, ছুরি, হাঙ্গর, ভোল, মেদসহ নানা ধরনের মাছ কিনছেন শুটকি ব্যবসায়ীরা৷ কেউ কেউ ওই সব মাছ পরিষ্কার করছেন, আবার কেউ ব্যস্ত শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে৷
বেতন বৈষম্য
নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লির মহালগুলোতে কর্মরতদের তিন চতুর্থাংশই নারী৷ লৈঙ্গিক কারণে বেতন বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন তাঁরা৷ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, সেখানে একই সময় কাজ করে একজন নারী পান মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা৷
নারী দুর্বল!
দীর্ঘ দিন নারীর প্রতি বৈষম্য চলে এলেও মালিকদের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই৷ নারীরাও চাকরি হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না৷ কথা বলতে গেলে অনেক শ্রমিককে তাড়িয়ে দেওয়া হয়৷ পুরুষদের তুলনায় নারীরা দুর্বল দাবি করে শুঁটকি মহাল মালিক নুরুল হাকিম বলেন, ‘‘এটা বৈষম্য না৷ নারীরা দুর্বল৷ তারা পুরুষদের মতো কাজ করতে পারে না৷ তাই তাদের বেতন কম দেওয়া হয়৷’’
দুই বছর ধরে শুঁটকি পল্লিতে জুহুরা
স্থানীয় আক্তার হোসেনের শুঁটকি পল্লিতে কাজ করেন জুহুরা খাতুন৷ স্বামী না থাকায় দুই বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গত দুই বছর ধরে এই শুঁটকিপল্লিতে কাজ করছেন৷ তিনি জানান, তিন বছর আগে স্বামী সেলিম উদ্দিন তাঁকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেন৷ তারপর তিনি এই পেশা বেছে নেন৷ ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মাছ বাছাই ও ধোয়াসহ নানা কাজ করে এক দিনে পান আড়াইশ টাকা৷
ট্রলারের খাঁচা নামালে ৫০০ টাকা
গভীর সাগরে মাছ আহরণ করে ট্রলারগুলো এসে ভেড়ে নাজিরারটেক উপকূলে৷ ট্রলারের খাঁচাগুলো ঠেলাগাড়িতে তুলে দিয়ে জাফর আলম দিনে পান পান ৫০০ টাকা৷ ওই টাকা দিয়েই চলে তাঁর সংসার৷ বর্ষা মৌসুমে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় তাঁরও কাজ থাকে না৷ ‘‘সেই সময় ছেলে-মেয়েদের খাবার জোগাতে খুব কষ্ট হয়ে যায়,’’ বলেন তিনি৷
ঠেলাই ভরসা
ট্রলার থেকে কাঁচা মাছের খাঁচাগুলো নামিয়ে তোলা হয় ঠেলাগাড়িতে৷ গাড়ি চালানোর জন্য রাস্তা না থাকায় এখানে পরিবহণের একমাত্র ভরসা ঠেলাগাড়ি৷ আর জোয়ার হলে ট্রলার থেকে শুঁটকি মহালে মাছ নেওয়া হয় ছোট ছোট নৌকায় করে৷
অবাধে চলছে শিশুশ্রম
পেটের তাগিদে প্রতিদিনই নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লিতে কাজ করতে আসছে শিশুরা৷ আবার জেলে-মহাজনদের অর্থের প্রলোভনে সাড়া দিয়ে অভিবাবকরাও পাঠাচ্ছেন শিশুদের৷ হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য মজুরি পাচ্ছে এই শিশুরা৷ একদিকে অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্যদিকে সামান্য ভুলের কারণে তাদের নির্মম-নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে শিশুরা৷
‘শিক্ষক’ হওয়ার স্বপ্ন ছিল মনোয়ারার
নাজিরারটেকে আবুল কাসেমের শুঁটকি পল্লিতে কাজ করেন মনোয়ারা আক্তার৷ ব য়স ১১ বছর৷ তার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে ‘শিক্ষক’ হয়ে উপকূলের ছেলে-মেয়েদের পড়াবে৷ সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না৷ বাবা অক্ষম হয়ে পড়ায় পরিবারের খাবার জোগাতে মনোয়ারা কাজ করছে শুঁটকি মহালে৷ তার মা-ও কাজ করেন এখানে৷ দিনে মনোয়ারা ২০০ থেকে ৩০০ পায় এবং তার মা পান ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা৷ এই দিয়ে পরিবারের খোরপোষের সঙ্গে তিন ভাই-বোনের লেখাপড়াও চলে৷