শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি বন্ধ হচ্ছে না কেন?
৩০ মার্চ ২০১৮রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ হোস্টেলে ২৬ মার্চ রাত ১২টার পর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ৯ জন ছাত্র বন্ধুর জন্মদিন পালন করছিল৷ তাতে ক্ষুব্ধ হন হাস্টেল সুপার এবং পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক মনিরুল ইসলাম সোহেল৷ তিনি জন্মদিন পালন বন্ধ করে দিয়ে ৯ ছাত্রকে এক লাইনে দাঁড় করান৷ এরপর আধা ঘণ্টা ধরে অ্যালুমুনিয়ামের রড দিয়ে তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন৷ পরে নির্যাতিত ছাত্ররা তাদের রক্তাক্ত ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়৷
নির্যাতনের শিকার একজন ছাত্র শাহরিয়ার আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা সীমার মধ্যে থেকেই কিছুটা হই-হুল্লোড় করছিলাম৷ কিন্তু আমাদের স্যার আমাদের কোনো কথা না শুনে প্রথমে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং পরে লাইনে দাঁড় করিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন৷ আধ ঘণ্টা ধরে এই নির্যাতন চলাকালে আমাদের কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি৷ তাঁর সঙ্গে থাকা আনেয়ার মোল্লা স্যার উল্টো নির্যাতনের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করেছেন৷’’
শাহরিয়ার আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এক পর্যায়ে তিনি থামার পর আমরা চিকিৎসকের কাছে নিতে বললে তিনি সে সুযোগও দেননি৷ পরে তিনি চলে গেলে আমরা প্রিন্সিপাল স্যারকে ঘটনা জানাই এবং হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিই৷ আমরা এখন হোস্টেলেই অবস্থান করছি৷ ২ এপ্রিল আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা৷’’
কলেজের প্রিন্সিপাল জসিম আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি৷ কমিটি প্রকৃত ঘটনা জানবে৷ তাঁরা দেখবেন, কার দায় কতটুকু৷ তারপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো৷ ইতিমধ্যেই শিক্ষক মনিরুল ইসলাসম সোহেলকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে৷'' তিনি জানান, ‘‘ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি দেয়া আমরা অ্যালাও করি না৷’’
বাংলাদেশে শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িতে শারীরিক শাস্তি নিয়ে ইউএনডিপি একটি জরিপ পরিচালনা করে ২০১৩ সালে৷ সাক্ষাৎকারভিত্তিক সেই জরিপে দেখা যায়৷ প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন জানিয়েছে যে, তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে৷ আর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন শিশু জানায় যে, তারা বাড়িতে অভিভাবকদের হাতে শারীরিক শাস্তি পেয়ে থাকে৷
আর ইউনিসেফ এর জরিপ বলছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৯১ ভাগ এবং বাড়িতে শতকরা ৭১ ভাগ শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার৷ জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে বেত বা লাঠির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে এবং ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্র এই বেত বা লাঠির শিকার হয়৷
এই দুই জরিপেই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের শিশুদের গড়ে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বাড়িতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম শিশুদের অধিকার ও পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে এরকম ২৬৭টি সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক৷ তাদের হিসাব মতে গত বছরের প্রথম ১০ মাসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে দুই হাজারের বেশি শিশু৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ২,১৯৭ এবং ২০১৩ সালে ১,১১৩ জন৷
২০১১ সালে হাইকোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়ার বিষয়টি বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে৷ আর হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি পরিপত্রও জারি করে৷ এই পরিপত্রই আইন৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা শাস্তিগুলো হলো: হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেওয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷ প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷
ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, কলেজ কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেয় তো দেখার অপেক্ষায় আছেন তারা৷ শিক্ষার্থিরা জানান, কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে তাদের অভিভাবকরা থানায় মামলা করবেন৷
শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে ফেসবুক থেকে নিজেদের রক্তাক্ত ছবি সরিয়ে নিয়েছে৷ এর কারণ জানতে চাইলে শাহরিয়ার বলেন, ‘‘কলেজের সুনামের কথা চিন্তা করে ফেসবুক থেকে রক্তাক্ত ছবি সরিয়ে ফেলেছি৷ আমরা এখন কোনো হুমকির মুখে নেই, তবে আমাদের বুঝানো হয়েছে৷’’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না৷ এর জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেদের এ নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে৷ কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা নেই৷ এটা বাধ্যতামূলক করা দরকার৷ আইন দিয়ে সব কিছু হয় না৷ যে শিক্ষক ছাত্রদের শারীরিক নির্যাতন করছেন তিনি হয়তো বুঝতেই পারছেন না তিনি খারাপ কাজ করছেন৷ এজন্য তাদের কাউন্সেলিং দরকার৷’’
তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষকের কাজ ছাত্রদের স্বপ্ন দেখানো৷ তাদের অবদমিত করা শিক্ষকের কাজ নয়৷ শিক্ষার্থীরা ভুল করতেই পারে৷ তাদের সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে সঠিক পথে পারিচালিত করাই শিক্ষকের কাজ৷ আর সেটা করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে, তাদের শাস্তি দিয়ে নয়৷ তাই শিক্ষকের এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দরকার৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তিতে তাদের দেহের চেয়ে মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বেশি৷ এতে শিক্ষার্থীর জীবন চরম ক্ষতির মুখে পড়তে পারে৷’’