শান্তির দাম কে চুকাবে?
১ সেপ্টেম্বর ২০২০একটা ছবি অনেক কথা বলে৷ এই যেমন একটা সিঁড়ি৷ করোনাকালে পাশাপাশি উঠে আসছেন মুখোশবিহীন তিনজন মানুষ৷ এদের মধ্যমনি জারেড কুশনার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা ও একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা৷ তার দু'পাশে দু'জন অতি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা৷ বাঁ পাশে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও'ব্রায়েন এবং ডান পাশে ইসরায়েলের জাতীয় উপদেষ্টা কর্মকর্তা মিইর বেন শাবাত৷ কিপা পরিহিত বেন-শাবাত চমৎকার আরবি বলেন৷
সোমবারের যে ছবিটি পৃথিবীর বড় বড় সব পত্রিকা টিভিজুড়ে আলো ছড়িয়েছে সেখানে এই তিনজন একটি চার্টার্ড এল আল এয়ারলাইনারের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন৷ পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকা ঘিরে গোটা বিশেক লোক৷ দুই দেশের উঁচ্চ পর্যায়ের একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল বিমান ভ্রমণে যাচ্ছেন৷ ইতিহাস সৃষ্টি করা এই ফ্লাইটটির গন্তব্য তেল আভিভ থেকে আবুধাবি৷
সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ১৩ মিনিটে বিমানটি ছেড়ে যায় তেল আভিভের মাটি৷ উদ্দেশ্য ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলিম আরব বিশ্বের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি চেষ্টা এবং ব্যবসার পথ তৈরি৷ আরো একটা উদ্দেশ্য হল লিটমাস পরীক্ষা করা৷ অর্থাৎ এই সম্পর্ক সফল হলে হয়ত অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির পথ খুঁজে পাবে৷ আরববিশ্ব খুঁজে পাবে ‘শান্তি’৷ শান্তি শব্দটি তিনদেশের ভাষায় (আরবি, হিব্রু ও ইংরেজি) লেখাও ছিল পাইলটের পাশের জানালায়৷
‘বন্ধুত্বের নিদর্শন’ রয়েছে ফ্লাইটটির নামকরণেও৷ এলওয়াই৯৭১ নামের ফ্লাইটটির ৯৭১ নম্বরটি মূলত আমিরাতের কান্ট্রি কোড৷ একইসঙ্গে ফেরত আসবার সময় এই ফ্লাইটের নাম এলওয়াই৯৭২ এবং ৯৭২ হলো ইসরায়েলের কান্ট্রি কোড৷ বিমান ওড়াবার আধঘণ্টা পর পাইলট ঘোষণা দেন যে বিমানটি পৌঁছেছে সৌদি আরবের আকাশসীমায়, যেন ইতিহাসের পথ পাড়ি দিচ্ছে বিমানটি৷ প্রথমবারের মতো সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করল ইসরায়েলের কোন কমার্শিয়াল ফ্লাইট৷ এর আগে অবশ্য ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স তাদের সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরায়েলে যাত্রী আনা নেয়া করত৷
তিন ঘণ্টা ১৭ মিনিটে প্রায় দুই হাজার ১১০ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে ফ্লাইটটি পৌঁছে আবুধাবিতে৷ সেখানে লাল গালিচা সংবর্ধনায় বরণ করা হয় তাদের৷ ঘটনাটি টিভিতে লাইভ দেখেন আমিরাতিরা৷
উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেন প্রতিনিধিরা৷ এরইমধ্যে দুই দেশে দূতাবাস খোলার ব্যাপারে একমত হয়েছে উভয়পক্ষ৷ অ্যামেরিকান প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দীর্ঘ আলোচনা করেন ‘নরমালাইজেশন’ বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে৷ পারস্পরিক যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ ছাড়াও বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচনা হয়৷ বৈঠক করেন উভয় দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বেন শাবাত ও শেখ তাহনুন বিন জায়েদ৷ তাদের বৈঠকটি বেশ দীর্ঘ হয়৷
প্রতিনিধি দলগুলোর আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট দেখা যায়, তা হলো আরব দেশগুলোর মধ্যে মিশর বা জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের যে কূটনৈতিক সম্পর্ক, আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক তার থেকে ভিন্ন হবে বলে দুই পক্ষেরই প্রত্যাশা৷ এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিরাতের ‘প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ’ আশাবাদী করে তুলেছে ইসরায়েলকে৷ জেরুসালেমে বসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবুধাবির আকাশে পত পত করে উড়তে থাকা স্বদেশি পতাকা দেখে যারপরনাই পুলকিত৷ প্রেস কনফারেন্সে তিনি একে বলেই ফেললেন, ‘ওয়ার্ম পিস’ বা উষ্ণ শান্তি৷ এই উষ্ণতার কারণ অবশ্য একেবারেই অর্থনৈতিক৷ দুই দেশের মধ্যে যে অর্থনৈতিক যোগাযোগ গড়ে উঠবে তাতে আমিরাতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকবে৷
স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনের জন্য আরব আমিরাতের এই ইঙ্গমার্কিন মেরুতে সরাসরি ঝুঁকে পড়া হৃদয়বিদারক ঘটনা৷ আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়ে সৌদি আরবেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার৷ সবমিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান বলয় ধাক্কা খেল আরেকবার৷ ইরান নিয়ে অস্বচ্ছন্দ আরব পক্ষগুলোকে এক করার ইসরায়েল-মার্কিন প্রচেষ্টা আরো জোরদার হবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ আর আপাতত মার্কিন নির্বাচনকে সামনে রেখে কুশনার তার শ্বশুর ট্রাম্পের প্লেটে নতুন সন্দেশযোগ নিয়েই ফিরছেন৷ আর আবুধাবি ও তেল আভিভ আরো অনেকবার লালগালিচা খুলবে, বোঝাই যায়৷ এরই মধ্যে নিমন্ত্রণও এসেছে নেতানিয়াহুর৷
তবে একটা কথা চালু আছে৷ ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু নেই৷ সবকিছুরই দাম আছে৷ তা দিতে হয়৷ আরব বিশ্বে এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের দাম কাউকে চুকাতে হবে কি না, কিংবা চুকাতে হলে কাকে, তাই এখন দেখার বিষয়৷