‘লাভ জিহাদ': মৌলবাদী হিন্দুদের দৌরাত্ম্য
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু না কিছু ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে হচ্ছে৷ মৌলবাদী হিন্দুরা যার নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ'৷ প্রথমদিকে নাম ছিল রোমিও জিহাদ৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কিছুতেই এই‘লাভ জিহাদ' মেনে নিতে পারছে না৷ কেন পারছে না ? কারণ, এটা তাদের মতে, ধর্মান্তর করা ছাড়া আর কিছুই না৷ এই অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম দম্পতির বাড়িতে গিয়ে চড়াও হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ৷ তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷
এই তো গত বৃহস্পতিবার দিল্লির উপকন্ঠে নয়ডার এক শিক্ষিতা হিন্দু তরুণী কৃষ্ণা এবং উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম যুবক সাদ্দাম মিরাটের আদালতে তাঁদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে গেলে তাঁদের ওপর চড়াও হয় মৌলবাদী হিন্দু সংগঠন বজরং দল৷ কিন্তু হিন্দু মেয়েটি বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় এই বিয়ে করছেন৷ বজরং দল নাছোড়বান্দা৷ তারা মনে করে এই ধরণের হিন্দু-মুসলিম বিবাহ ধর্মান্তরিত করার একটা ছল৷ তারা কখনোই এটা হতে দেবে না৷ কারণ, এই ধরণের বিয়ে বন্ধ করা তাঁদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ পুলিশ তাঁদের বাঁচাতে গেলে বজরং দলের কর্মীরা ‘লাভ জিহাদকে রক্ষা করছে', এই অভিযোগে পুলিশের ওপরও হামলা চালায়৷ পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়৷
এর কয়েকদিন আগের ঘটনা৷ উত্তর প্রদেশের হাপুর শহরে বিদ্যা শ্রীবাস্তব এবং শোয়েব আলম দম্পতির বাড়িতে চড়াও হয় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মীরা৷ তাদের অভিযোগ, আলম নাকি ভুলিয়ে ভালিয়ে বিদ্যাকে বিয়েতে রাজি করায়৷ যদিও বিদ্যা সেকথা মানেননি৷ তিনি বলেছেন, নিজের ইচ্ছায় আলমকে বিয়ে করেছেন৷ আদতে বিহারের বাসিন্দা এই দম্পতি পরিবারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে আদালতে গিয়ে বিয়ে করেন এবং পরে হাপুরে এসে থাকেন৷ হিন্দুত্ববাদী কর্মীদের হেনস্থার হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঐ দম্পতির নিরাপত্তার জন্য তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে৷হিন্দুত্ববাদীরা আলমকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে৷ তথাকথিত লাভ জিহাদের জেরেই নাকি কেরালার একটি হিন্দু তরুণী অখিলা ওরফে হাদিয়া, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করেন মুসলিম যুবক সাফিন জাহানকে৷ হাদিয়ার পরিবার জোর করে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ দায়ের করে কেরালা হাইকোর্টে৷
হাইকোর্ট সেই বিয়ে অবৈধ বলে রায় দিলে হাদিয়ার স্বামী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন৷ শীর্ষ আদালত জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ-কে ঘটনার তদন্ত করার নির্দেশ দেন৷ এআইএ'র প্রথমিক রিপোর্টে বলা হয়, এই ধরনের ধর্মান্তকরণের পেছনে কাজ করছে একটা সংগঠিত চক্র৷ যদিও হাদিয়া তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন৷ কেরালায় অনুরূপ ঘটনা হিন্দু তরুণী আথিলা নাম্বিয়ারকে নিয়ে৷ তাঁকেও নাকি জোর করে ধর্মান্তরিত করার পর এক মুসলিম যুবক বিয়ে করেন৷ আথিলার বাবা ও মা কেরালা হাইকোর্টে জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করার অভিযোগে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দাখিল করেন৷
জাতীয় তদন্তকারী এজেন্সির পক্ষ থেকে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁরা হিন্দু মেয়েদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ৩২টি ঘটনা খতিয়ে দেখছে, তাতে দেখা গেছে এর পেছনে একটা সংগঠিত চক্র কাজ করছে৷ এতে গোটা বিতর্কটা হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে রসদ তুলে দিয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও লাভ জিহাদের মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজে পান৷ নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে হুঙ্কার দেন, একজন হিন্দু মেয়েকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করলে আমরা ১০০ জন মুসলিম মেয়েকে ধর্মান্তরিত করবো৷
এই রকম ভিন্ন ধর্মের বিয়ের বহু ঘটনা আকছারই ঘটছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দুত্ববাদীদের রক্ত চক্ষুকে অগ্রাহ্য করে৷ তবুও লাভ জিহাদের বড় শিকার মেয়েরাই৷ তবে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ অংশ মনে করছেন, হিন্দু রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মতো সংগঠনগুলি৷ সেখানে জনসংখ্যার আনুপাতিক হার একটা বড় ভূমিকা আছে৷ এরই পাল্টা লাভ ‘ত্রিশুল'-এর মতো জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবিকা সমিতি৷ তারা মনে করেন, মোদী সরকার যখন তিন তালাক প্রথা থেকে মুসলিম মহিলাদের বাঁচাতে ঐ প্রথা রদ করতে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সক্ষম হন, সেক্ষেত্রে লাভ জিহাদের বিষয়েও একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে মোদী সরকার৷ সেখানে গৈরিক রং যেন বাধা না হয়৷
এ প্রসঙ্গে আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷