লকডাউনে ঘরে ঘরে ফিরেছে রেডিও
২৫ এপ্রিল ২০২০করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে ভারতে লকডাউন চলছে৷ ঘরবন্দি মানুষের অবসর যাপনের উপায় মূলত বিনোদন৷ এই সুযোগে টেলিভিশনের দাপটে কোণঠাসা রেডিও তার হারানো জনপ্রিয়তা একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছে৷ সরকার পরিচালনাধীন আকাশবাণী ছাড়াও বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক এফএম চ্যানেলের অনুষ্ঠান শোনা যায় পশ্চিমবঙ্গে৷ এই চ্যানেলগুলির শ্রোতার সংখ্যা লকডাউন চলার সময়ে অনেকটা বেড়েছে৷ চ্যানেলের দাবি অনুযায়ী, ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে শ্রোতার সংখ্যা৷ মূলত সংগীতনির্ভর বিনোদনের পসরা নিয়ে এফএম দ্রুত মানুষকে স্পর্শ করেছে৷ অবসরের সময় অন্যান্য মাধ্যমের মতো জনপ্রিয়তা বেড়েছে বেতারেরও৷ বাংলার সংস্কৃতি জগতের দীর্ঘদিনের কর্মী, সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেতারের জনপ্রিয়তা গোটা বিশ্বেই ক্রমশ বাড়ছে৷ এটা খুব শুভ লক্ষণ৷ বেতার একটি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরে৷ টেলিভিশন সেভাবে পারে না৷’’
শুধু আকাশবাণী নয়, প্রবীণ এই শিল্পী বেতারের নয়া সংস্করণেও অনুষ্ঠান করেছেন৷ লকডাউনের সময় শহরে জন্ম নিয়েছে নতুন চ্যানেল রেডিও কোয়ারান্টাইন কলকাতা৷ ২৪ মার্চ বিকেল থেকে এই ডিজিটাল রেডিওর লাইভ স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে৷ গান শোনানো হচ্ছে, রয়েছে গল্প ও কবিতা পাঠ৷ ছোটদের জন্য অনু্ষ্ঠান হচ্ছে৷ সঙ্গে অবশ্যই করোনা নিয়ে সতর্কবাণী৷ গীতিকার মোহিনী চৌধুরীকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন শুভেন্দু মাইতি৷ এই ডিজিটাল রেডিওতে অনুষ্ঠান করেছেন অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘ভারত রামচরিতমানসের দেশ৷ এখানে মৌখিক সাহিত্য ও শ্রুতির বড় স্থান৷ শ্রুতি কিন্তু দৃশ্যের চেয়ে মানবসভ্যতার ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ যখন আমাদের দুয়ার রুদ্ধ, আমরা ঘরে বদ্ধ, তখন শ্রুতি মনের জানলা খুলে দিচ্ছে৷’’ শুভেন্দুর মতো সঞ্জয়ও আশাবাদী, ‘‘পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই রেডিওর সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন হবে৷ এশিয়া ও আফ্রিকাতে নিশ্চিতভাবে৷’’
তাঁর বক্তব্য, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত দেখে বোঝা যায়, মানুষ আর কেন্দ্রীভূত মাধ্যমে বিশ্বাসী নয়৷ তাই ঘর থেকে ঘরে, কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্প পরিসরে সম্প্রচারের গুরুত্ব বাড়ছে৷ সে কারণেই আকাশবাণীর মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে কমিউনিটি রেডিওর উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷’’
কলকাতায় ২০০৮ সালে চালু হয়েছিল পূর্ব ভারতের প্রথম কমিউনিটি রেডিও৷ ৯০.৮ মেগাহার্ৎজে প্রচারিত হয় রেডিও জেইউ৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বেতারের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়, সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে৷ কিন্তু, লকডাউনের আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অনেক প্রসারিত হয়েছে রেডিও জেইউ-র ভূমিকা৷ এই বেতারের আহ্বায়ক অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী বলেন, ‘‘অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে আমরা ইউটিউব-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছি৷ অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেন৷ তাঁদের কথা তুলে ধরছি৷ ইতিমধ্যে বাউল সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে৷’’
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনুষ্ঠান রেকর্ড করার সরঞ্জাম বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ বাড়িতে বসেই রেকর্ড করা হচ্ছে অনুষ্ঠান, আপলোড হচ্ছে ইউটিউব-এ৷ অধ্যাপক লাহিড়ী জানান, তাঁদের ইমেলে প্রতিদিন অজস্র অভাব-অভিযোগ আসছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের সাহায্যে সেগুলি তাঁরা প্রশাসনের নজরে আনছেন, স্থানীয় স্তরে সমাধানের চেষ্টাও করছেন৷
লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর সপ্তাহখানেকের জন্য আকাশবাণী কলকাতা অনেকটাই নীরব হয়ে গিয়েছিল৷ এপ্রিলের গোড়া থেকে কিছুটা ছন্দে ফিরেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠান৷ যদিও নিয়মিত অধিকাংশ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে না৷ করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান শোনানো হচ্ছে৷ সঙ্গে অন্যান্য সাংস্কৃতিক আয়োজন৷ তাহলে কি নস্ট্যালজিয়া থেকে আবার বর্তমানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে আকাশবাণী-সহ সমগ্র বেতার মাধ্যম? শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘এটা সভ্যতার পক্ষে মঙ্গলজনক৷ টেলিভিশন দৃশ্য চাপিয়ে দেয়৷ বেতার কল্পনা করতে সাহায্য করে৷ শুধু দৃশ্যনির্ভর হয়ে উঠলে দুই প্রজন্ম পর মানুষের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে৷ বেতার সেই বিপর্যয় থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে৷’’