রোহিঙ্গা শিবিরে বারবার আগুন, ঠেকানোর ব্যবস্থা কতটুকু?
১৪ জানুয়ারি ২০২২রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, শিবিরে বারবার অসাবধানতায় আগুন লাগছে৷ তবে এর পেছনে কোনো নাশকতামূলক তৎপরতা রয়েছে কিনা, সে প্রশ্নও এখন সাধারণ রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে৷
প্রতিবছর শিবিরগুলোতে ৬০-৫০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের খুব বেশি জোড়ালো ভূমিকা চোখে পড়ে না৷ শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই৷ এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না৷
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি৷ যদিও রোহিঙ্গাদের হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷
চলতি বছর ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্য সবশেষ ৯ জানুয়ারি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে গেছে৷ কিন্তু টেকনাফের চেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে৷
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, ‘‘গেল বছরে উখিয়া শরণার্থী শিবিরে অর্ধশতাধিকের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ক্যাম্পে শীত মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে৷ তাদের গ্যাস সিলিন্ডার ও অসর্তকতার কারণে সামনে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটার আশঙ্কা রয়েছে৷ এ বছরে এখানে দুইটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে৷ তবুও আমরা সবাইকে আরো বেশি সর্তক থাকতে বলেছি৷''
এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টেকনাফ স্টেশনের কর্মকর্তা মুকুল কুমার নাথ জানান, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ৷ সেখানে ঝুপড়ি ঘর আছে৷ দুর্গম পাহাড়ে অবস্থানের কারণে আগুন লাগলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না৷ বেশিরভাগ ক্যাম্পে রাস্তার কারণে ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ আবার পানির উৎসের সংকটও বেশি হওয়ার ফলে আগুন লাগলে শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয় বলে জানান তিনি৷
কিছু অগ্নিকাণ্ড ‘পরিকল্পিত'
গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীর একটি শিবিরে আগুন লেগে শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ আশ্রয় হারিয়েছিলেন প্রায় ৪৫ হাজার শরণার্থী৷ যদিও সেই সময় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর নিহতের সংখ্যা ১৫ জন বলে উল্লেখ করেছিল৷
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যাণ্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের কিছু ঘটনা রহস্যজনক মনে হয়৷ এর পেছনে কোনো চক্রের হাত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ বের করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে সবসময়ই এখানকার মানুষের মাঝে আগুন লাগার ভয়ভীতি থাকবে৷ তাই এ ধরনের ঘটনা রোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার৷ গত বছর রোহিঙ্গারা ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছিল৷''
অনেকদিন ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, ‘‘আগের তুলনায় শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমেছে৷ তবে এটা সত্য যে অগ্নিকাণ্ডের কিছু ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হয়৷ শিবিরে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে মনে হয় কিছু ঘটনা ‘পরিকল্পিত'৷ আবার কিছু ঘটনা অসাবধানতার কারণে ঘটছে৷ এছাড়া শিবিরে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে৷ তাদের কারণে এ ধরনের ঘটনা উৎপতির সুযোগও রয়েছে৷ বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আগুনের কারণ চিহ্নিত করার ‘প্রযুক্তি' আমাদের আদৌ কি আছে?''
এ বিষয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) সামছু-দৌজা নয়ন বলেন, ‘‘আগুনের কারণ চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আছে কিনা সেটি আমার জানা নেই৷ তবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে৷ সম্প্রতি শফিউল্লাহ কাটা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা একটি প্রতিবেদন দিব৷ কিন্তু তার বিষয়ে এখন কিছু বলতে চাই না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আগুনে পোড়া শিবিরগুলোতে নতুন ঘর তৈরির ক্ষেত্রে ঘরগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে তৈরি করার পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী রাখা এবং ফায়ারের কর্মীরা যাতে সহজে ঢুকতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হবে৷ পাশাপাশি কিছু রাস্তার মোড় চওড়া করছি, যাতে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলোও ঢুকতে পারে৷''
উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা শিবিরে আগুনের ঘটনায় রোহিঙ্গা নেতা ও সিপিপি কর্মী মো. মিয়ার ঘর আগুনে পুড়ে যায়৷ তিনি জানান, ‘‘ওই দিন বিকেলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত এগিয়ে এসে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রগুলো নিয়ে আগুন নেভাতে গেলে দেখা যায় সেই যন্ত্র কাজ করছিল না বরং এ যন্ত্রগুলো থেকে পানি বের হচ্ছিল৷ তাছাড়া এমন জায়গায় আগুন ধরেছে যা ছিল খুব ঘিঞ্জি ছিল, ফলে সেখানে পৌঁছানো খুব মুশকিল ছিল৷''
বারবার কেন ক্যাম্পে আগুন লাগে এমন প্রশ্নের জবাবে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা অনেকে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করতে জানে না৷ আর যারা জানেন তাদের অধিকাংশই অসর্তকতায় রান্নার কাজ করে থাকেন৷ আবার দেখা যায় অনেকে অভাবের কারণে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করে কাঠের লাকরি ব্যবহার করে৷ এসব কারণে শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷ বিশেষ করে শিবিরগুলো ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে শিবিরে ফায়ার সার্ভিস মজুদ রাখা দরকার৷ তা যদি সম্ভব না হয় সরকারের উচিত আগুন প্রতিরোধে শিবিরের ঘরগুলো পরিকল্পিভাবে (ফাঁকা) গড়ে তুলা৷ পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলে যাতে দ্রুত সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌছতে পারে, সেই ব্যবস্থা রাখা দরকার৷''
সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ
গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী-৮ ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজার ১৬৫টি বসতি পুড়ে যায়৷ ১১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ ঐ ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল৷ এতে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল৷ কিন্তু সেগুলো বাস্তাবায়িত হয়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা৷
জানতে চাইলে কক্সবাজারের শিবিরে রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং জানান, ‘‘শিবিরে কেন বারবার আগুন লাগে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে রোহিঙ্গার মাঝে৷ ক্ষতিগ্রস্তরা অনেক সময় আগুন লাগার পেছনে রহস্য লুকিয়ে থাকার অভিযোগ আনলেও সেই রহস্যের জট খুলে না কখনও৷ এমনকি তাদের অভিযোগ আমলে নেয়ার কোনও নজির নেই৷ তাছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলো কি আলোর মুখ দেখে?''
তিনি বলেন, ‘‘শিবিরে ঘনবসতি হওয়ার কারণে দ্রুত চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ এর জন্য ঘরগুলো ফাঁকা করে নির্মাণ করা উচিত৷ তাছাড়া শিবিরে তাৎক্ষণিক আগুন নেভানোর অগ্নিনির্বাপন ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রসহ পানি ব্যবস্থার বারবার বলে আসলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি৷''
এ বিষয়ে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীরের মতে, ‘‘বছরের শুরুতে আগুন লাগার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত নয়, এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়৷ কারণ এর আগে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর জন্য একটি সংগঠিত চক্রের কাজ করার অভিযোগ উঠেছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সংস্থা, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় ছাড়া এসব আগুনের প্রকৃত কারণ বের করা সম্ভব হবে না৷ সমন্বিত তদন্তের মাধ্যমে কোন অগ্নিকাণ্ডটি দুর্ঘটনা, আর কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বের করা দরকার৷ অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাবে না৷''