রোমাদের কথা
২৯ আগস্ট ২০১৩ডুইসবুর্গের রাইনহাউজেন এলাকার আদিবাসিন্দাদেরও ঠিক দোষ দেওয়া যায় না৷ রোমাদের যে কলোনিটিতে আবাস, সেখানে রাস্তায় রাস্তায় আবর্জনা, প্লাস্টিকের বাক্সো, কাঁচের বোতল ইত্যাদি গড়াগড়ি যাচ্ছে৷ বাতাসে প্রস্রাবের গন্ধ৷ গর্তে জল জমে রয়েছে৷ তারই মধ্যে ফুটবল খেলছে ছেলের দল৷ মাথায় স্কার্ফ বাঁধা মহিলারা আর মেয়েরা দোতলা-তিনতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে সেই খেলা দেখছেন৷ বারান্দাগুলোতেও জামাকাপড় শুকোচ্ছেন, পুরনো কার্পেট, ডিশ অ্যানটেনা, ময়লা, সব কিছু লাগানো কিংবা ফেলা আছে৷ সাধে কি পাড়ার লোকেরা এই বাড়িটির নাম রেখেছে ‘‘প্রোবলেম হাউজ'', মানে ‘সমস্যার বাড়ি'!
বাড়ির নীচ দিয়ে যাবার উপায় নেই: মাথায় ভাঙা কাপ-প্লেট কিংবা বাচ্চাদের প্যাম্পার্স এসে পড়তে পারে৷ কেননা ‘সমস্যার বাড়ির' বাসিন্দাদের ময়লা ফেলার সহজ পথ ও পন্থা হলো: জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া, তা সেটা যার মাথায় গিয়েই পড়ুক না কেন৷ ইন ডেন পেশেন নামধারী রাস্তার তিন থেকে পাঁচ নম্বর বাড়িগুলোর কোনো একটাতে ঢুকতে গেলে স্থানীয় মাতব্বরদের নজর আর সেই সঙ্গে কচিকাঁচাদের গালিগালাজ, অশালীন ভঙ্গি সহ্য করতে হবে৷ এই তিনটি বাড়ির অধিকাংশ বাসিন্দা রোমা৷
উগ্র বামপন্থিদের দরদ
‘সমস্যার বাড়ি' নিয়েও রাজনীতির ঘোঁট৷ স্থানীয় বাসিন্দারা ডুইসবুর্গের রাইনহাউজেন এলাকায় রোমাদের বাসের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে একট মিটিং করছিলেন৷ সেই সময় একদল মুখোশধারী এসে তাদের মারধোর করে, পেপার স্প্রে ছিটায়৷ আহত হন বেশ কয়েকজন, একজনের আঘাত গুরুতর৷ আসলে ‘‘নাগরিকদের জন্য নাগরিক'' নাম দিয়ে একটি স্থানীয় কমিটি মিটিংটা ডেকেছিল পাড়ার পুরনো বাসিন্দা ও রোমাদের মধ্যে সমঝোতার আশায়৷ কিন্তু রোমাদের কেউই আসেননি – কেননা তাদের কেউই জার্মান জানেন না কিংবা বলতে পারেন না৷
‘‘নাগরিকদের জন্য নাগরিক'' কমিটি তাদের সমঝোতা মিটিংয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থিরা এসে হল্লা করতে পারে, এমন আশঙ্কা করছিল, কিন্তু যারা আসে এবং হামলা করে তারা ছিল ‘লিংকস রাডিকালে', অর্থাৎ উগ্র বামপন্থি৷ এদের ‘লিংকস আউটোনোমে', অর্থাৎ নির্দলীয় বামপন্থিও বলা হয়৷ এদের যে আধা-সংগঠিত গোষ্ঠী আছে প্রায় সব শহরে, তারা নিজেদের ‘অ্যান্টিফা' বা অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট বলে৷ এই অ্যান্টিফারাই এসেছিল রাইনহাউজেনে রোমাদের প্রতি তাদের সমর্থন জানাতে৷
অনাকাঙ্খিত অতিথি
ডুইসবুর্গের কাছেই ক্রুপ সংস্থার ইস্পাতের কারখানা বন্ধ হওয়া যাবৎ বহু বাড়িঘর খালি পড়ে আছে, ভাড়াও সস্তা৷ তাই পূর্ব ইউরোপের মানুষজন এখানে বাসা পেয়েছেন৷ প্রায় সাত-আট হাজার রোমার বাস এই শহরে৷ তবে ‘সমস্যার বাড়িতে' কতজন রোমার বাস, সেটা বোধহয় বাড়ির মালিক নিজেও জানেন না৷
রোমারা ভবঘুরে উপজাতি৷ ইউরোপেরই মানুষ৷ বিভিন্ন দেশে বাস এবং এককালে সারা ইউরোপ গানবাজনা করে বেরিয়েছেন তারা৷ নাৎসি আমলে তাদের প্রায় ইহুদিদের মতোই নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ নব্যনাৎসিরা আজও তাদের ওপর চড়াও হতে পারে, এটাই ছিল রাইনহাউজেনবাসীদের আরেক শঙ্কা৷ যে কারণে ‘‘নাগরিকদের জন্য নাগরিক'' কমিটি মালিকের উপর চাপ দিয়ে ‘সমস্যার বাড়িতে' ফায়ারপ্রুফ দরজা বসানোর ব্যবস্থা করেছে৷ কমিটির তরফ থেকে রাতেও এখানে টহল দেওয়া হয়, পরে উগ্র বামপন্থিরাও যে প্রহরায় যোগ দিয়েছে৷
কিন্তু তা বলে রাইনহাউজেনের বাসিন্দারা যে রোমাদের বসবাসের ধরণ মেনে নিয়েছেন, এমন নয়৷ চিৎকার-চেঁচামেচি, নোংরা, অশান্তি – এসব সহ্য করতে হয় তাদের৷ ‘‘ওরা বাগানটাকে বাথরুম হিসেবে ব্যবহার করে৷ রাতে এখানে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়ায়৷'' অনেকেই এ পাড়ার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবছেন৷ উত্তর রাইন পশ্চিম ফালিয়া রাজ্যের সরকার ভাবছেন ভাড়াবাড়ির ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে নতুন আইন করার কথা৷
শিক্ষা, না শিশু ভাতা?
কিন্তু ডুইসবুর্গের বাসিন্দাদের এক-তৃতীয়াংশই আজ অভিবাসী কিংবা অভিবাসী বংশোদ্ভূত৷ কাজেই পৌর প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা এই সহাবস্থানের সমস্যার সমাধানের জন্য শিক্ষার উপর নির্ভর করবেন৷ বিদেশ থেকে যে রোমারা এসেছেন, তারা সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে জীবন কাটিয়েছেন৷ কিন্তু তাদের সন্তানদের শিক্ষার মাধ্যমে এ দেশের, অর্থাৎ জার্মানির মানুষ করে তোলা সম্ভব, বলে বিশ্বাস করেন এলিজাবেথ পাটের, যিনি ডুইসবুর্গ পৌর প্রশাসনের হয়ে অভিবাসী পরিবারবর্গের শিশুদের উৎসাহপ্রদানের দায়িত্বে আছেন৷
সমালোচকরা বলেন: রোমারা জানেন, জার্মানিতে শিশু ভাতা পাওয়া যায়৷ প্রথম দুই সন্তানের জন্য সন্তান প্রতি মাসে ১৮৪ ইউরো৷ চতুর্থ সন্তান থেকে মাসে ২১৫ ইউরো৷ তারা যেখান থেকে আসছেন, সেখানে যে ধরণের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে কিংবা পাননি – তার সঙ্গে জার্মানির এই আকাশ-পাতাল তফাৎটাই তাদের এই সমাজের অংশ হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷