1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়ে কি আতঙ্ক বাড়ছে?

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মূলত রাজনীতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শরণার্থী এবং অভিবাসন সম্পর্কিত ইস্যু কভার করেন৷ পাশাপাশি জার্মানি ও ইউরোপে জীবনযাপনের নানা দিকও তুলে ধরেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম
১৪ জানুয়ারি ২০২২

ক্রসফায়ার, হত্যা, আগুন - কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এসব হরহামেশাই ঘটছে৷ মিয়ানমারে ধর্ষণ, নিপীড়ন, হত্যা থেকে বাঁচতে একসময় বাংলাদেশ ছিল রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়৷ কিন্তু সেই আশ্রয়েও কি তাদের ভয় বাড়ছে?

https://p.dw.com/p/45Wqg
Bangladesch Großbrand in Rohingya Flüchtlingscamp - Hunderte vermisst
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

 সাতলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য ২০১৭ সালে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ৷ মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে একদল বিচ্ছিন্নতাবাদীর ‘হামলার ঘটনার' পর রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক দমনপীড়ন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী৷ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷ অনেককে হত্যা করা হয়, অনেক নারী হন ধর্ষণের শিকার৷

সেই দমনপীড়ন থেকে বাঁচতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে সীমান্তে জড়ো হন হাজার হাজার রোহিঙ্গা৷ বাংলাদেশ তাদের ফিরিয়ে দেয়নি৷ বরং সীমান্ত খুলে দিয়ে মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি৷

বাংলাদেশের এই মানবতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে৷ দেশটিতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের খরচ মেটাতে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ এবং উন্নয়নসংস্থা৷

রোহিঙ্গাদেরকে নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার৷ আর তাদের ঘিরে সংকটও নতুন নয়৷ গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, আবার কখনো কখনো পরিস্থিতি অনুকূল মনে করলে অনেকে ফিরেও গেছে৷ তবে, ২০১৭ সালের মতো একবারে এত বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেনি৷

ঢাকা কি ধৈর্য হারাচ্ছে?

দশলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার চমৎকার উদাহরণ তৈরি করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা কিছুটা ধৈর্য হারাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে৷ বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন৷

বিবিসি বাংলাকে সেসময় তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এক সময় কঠোর হবে৷ এখন তো তারা খুব সুখে আছে৷ কিন্তু সুখে খুব বেশিদিন থাকবে না৷''

দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ‘সুখ' গত দুই বছরে বেশ ভালোই কমে গেছে৷ সেটা কীভাবে কমেছে, কারা কমিয়েছে, কেন কমিয়েছে তা বিস্তারিত বলতে অনেক তথ্যপ্রমাণ, অনুসন্ধান প্রয়োজন৷ তবে নানা সংস্থার প্রকাশিত পরিসংখ্যান এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে কিছুটা ধারনা পাওয়া যায়৷

ক্রসফায়ার ১২৫, হত্যা ১০৮

কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোতে গত কয়েকবছরে ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যার অনেক ঘটনা ঘটেছে৷

পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই অবধি অন্তত ১২৫জন রোহিঙ্গা শরণার্থী কথিত ‘ক্রসফায়ার' বা ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন৷ এদের মধ্যে নারীও রয়েছেন৷

নিরাপত্তা বাহিনী যেসব ঘটনাকে ক্রসফায়ার বলছে, সেগুলো নিয়ে নানা রকম প্রশ্নও রয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনে করে, এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ব়্যাব এবং সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে৷

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) গত আট অক্টোবর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আগের চার বছরে টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ১০৮ জন নিহত হয়েছেন৷ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে বিপিও৷ 

এক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর৷ দেশেবিদেশে রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে একদল অস্ত্রধারী৷ তার জীবনের উপর হুমকি থাকার বিষয়টি আগে থেকে জানা গেলেও পুলিশ তাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়৷

আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলেছবি: DW/Matthias Müller

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আগুন

রোহিঙ্গা শিবিরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) সম্প্রতি জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের হার উদ্বেগনজনক হারে বাড়ছে৷ ২০২১ সালের প্রথম চারমাসে রোহিঙ্গা শিবিরে ৮৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যা আগের বছরের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি৷ অগ্নিকাণ্ডে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, গৃহহীন হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ৷

এইচআরডাব্লিউ দাবি করেছে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আগুন অপেক্ষাকৃত কম লাগবে এবং বর্ষাবাদল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও টিকে থাকবে এমন ঘরবাড়ি তৈরি করতে দিচ্ছে না৷ বরং বিভিন্ন শিবির ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করা হয়েছে যেগুলো অগ্নিকাণ্ডের সময় মানুষের বিপদ বাড়াচ্ছে৷

চলতি বছরও ইতোমধ্যে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ এসব ঘটনার পেছনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবহেলার কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ নাশকতার কথাও বলছেন৷ তবে, বাস্তবে কী ঘটছে সেটা তেমন একটা জানা যাচ্ছে না৷ কেননা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর তদন্ত ঠিকভাবে হচ্ছে না৷

কমছে অন্যান্য সুযোগসুবিধাও

গত কয়েকবছরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ডিজিটাল যোগাযোগের উপরও নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করা হয়েছে৷ তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারও নানাভাবে কমানো হয়েছে৷ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না৷ এমনকি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷

মিয়ানমারের বিবেচনায় রোহিঙ্গারা সেদেশের নাগরিক নয়, বাংলাদেশের বিবেচনায় তারা শরণার্থী নয়৷ ফলে রোহিঙ্গারা দেশ দুটিতে নাগরিক বা শরণার্থী হিসেবে কোনো অধিকার পাচ্ছে না৷

এসব কিছু দেখলে একটি বিষয় বোঝা যায়, তাহচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে একধরনের ভয় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে৷ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর কয়েকমাস যে সুখ-শান্তির খোঁজ তারা পেয়েছিলেন সেটা এখন পড়তির দিকে৷ বরং ক্রসফায়ার, হত্যা, আগুনের মতো ঘটনা বারবার ঘটায় শিবিরগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে৷

এই আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় কার, কী সুবিধা হচ্ছে বলা কঠিন৷ তবে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে এই আতঙ্ক ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি না৷ বরং বাংলাদেশ ও পশ্চিমা সমাজের উচিত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আগানো যাতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে দেশটির নাগরিকত্ব দিয়ে ফেরত নেয়৷

হতাশার কথা হচ্ছে, পশ্চিমা সমাজ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খরচ মেটালেও মিয়ানমারের উপর তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টি করছে না৷ ফলে যে উদারতা দেখিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল, তা এখন হতাশায় পরিণত হচ্ছে৷

সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত