রাষ্ট্র তুমি কার?
২৭ নভেম্বর ২০১৪কাদের মোল্লার আপিল মামলায় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷ ঐতিহাসিক ঐ রায়ের মাধ্যমে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ এরপর ৫ ডিসেম্বর প্রকাশ হয় পূর্ণাঙ্গ রায়৷ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায় কার্যকরের প্রশ্ন উঠলে আসামিপক্ষ বিচারপতির কাছ থেকে ‘স্টে অর্ডার' নিয়ে পরদিন রিভিউ করার সুযোগ দাবি করে আপিল বিভাগে আবেদন করে৷ ১১ ও ১২ ডিসেম্বর এর শুনানি হয়৷ আসামিপক্ষের করা দুটি আবেদন ১২ ডিসেম্বর খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ৷ এর ফলে ফাঁসির রায় কার্যকরে আর কোনো বাধা থাকে না৷ তাই সেদিনই রাতে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
২৫ নভেম্বর ২০১৪, কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন সংক্রান্ত আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়৷ এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যুদ্ধাপরাধীরা আপিল বিভাগের রায়ের পর রিভিউ করতে পারবে৷ অথচ আমরা জানি যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের সেই সুযোগ নেই৷ বরং উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে – ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোনো প্রতিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করিবার কোনো অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না৷'
প্রসঙ্গত ওই (৩) দফায় বলা হয়, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য (বা অন্য কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন) কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সম্বলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থি, এই কারণে বাতিল বা বেআইনি হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না৷'
উল্লেখ্য, ৪৭ অনুচ্ছেদের মূল সংশোধনীটি ১৯৭৩ সালের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছিল৷ এটি মূলত সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল৷ পরে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ এর ফলে যেসব ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের সাংবিধানিক অধিকার নেই৷ রিভিউর আবেদন দাখিল করার বিষয়টি একটি সাংবিধানিক অধিকার৷ তবে এই বিধানটি শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷
সংবিধানের পরিষ্কার বিধান থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীরা রিভিউ করার সুযোগ পেল কীভাবে – তা আমাদের বোধগম্য হলো না৷ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাষ্ট্রের বিচারায়তনের সর্বোচ্চ ফোরাম৷ আইনের প্রতি আমরা সম্পূর্ণরূপে শ্রদ্ধাশীল৷ তারপরও আপিল বিভাগের প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ করার অধিকার দেওয়ার বিষয়টি আমাদের হতাশ করেছে৷ ৩০ লাখ শহিদের পরিবার এতে মর্মাহত হয়েছে৷ কারণ এর মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে আশঙ্কা রয়েছে৷
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রিভিউ পিটিশনের যে ৬৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছে, তা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে৷ এর আগে ২০১৩ সালের ১১ ও ১২ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত যে শুনানি হয় তার বিষয়বস্তু সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর শুনানির সময় মাননীয় আপিল বিভাগ যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের যুক্তিতে অমিল রয়েছে৷ শুনানির সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘‘রিভিউ কোনো প্রতিকার নয়৷ এটা সাংবিধানিক ও সুপ্রিম কোর্টের বিধি অনুযায়ী আদালতের সহজাত ক্ষমতা৷''
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘সংসদের যে কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো বিধি সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা ওই বিভাগের থাকবে৷ এখানে সুনির্দিষ্টভাবে আপিল বিভাগের ক্ষমতা বোঝানো হয়েছে৷ প্রতিকারের কথা বলা হয়নি৷
তখন আদালত বলেছিল, এ (সহজাত) ক্ষমতা হচ্ছে শর্তযুক্ত৷ আর শর্ত হচ্ছে আইনে (ট্রাইব্যুনাল) বেঁধে দেওয়া শর্ত৷ আদালত আরও বলেছিল, ‘এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়৷' কিন্তু দুঃখজনকভাবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালতের এই অবস্থান আমরা খুঁজে পাচ্ছি না৷
রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ থেকে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে তুলে ধরা হয়েছে৷ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কোনো যুদ্ধাপরাধী ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে দণ্ডিত হলে রিভিউ আবেদন করতে পারবে না৷ অন্যদিকে আসামিপক্ষ থেকে সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ ও আপিল বিভাগের রুলের ২৬ নম্বর আদেশের কথা উল্লেখ করে রিভিউ-এর সুযোগ চাওয়া হয়৷
পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে: Before entering into the merit of the matter, the learned Attorney General has raised a preliminary point about the maintainability of review petitions. According to him, in view of Article 47A(2) of the Constitution, review petitions are not maintainable from the judgment of this Division, in the absence of any provision for review in the Act XIX of 1973. It is contended that against a conviction or sentence or an order of acquittal or inadequacy of sentence, there is only one remedy of appeal available to a convicted person and the Government and the informant and the complainant, as the case may be, can prefer an appeal under section 21 of the Act of 1973 before this Division. After the disposal of the appeals, the judgment has attained finality and it cannot be challenged by resorting to the constitutional provision, which has totally been ousted by the Constitution (Fifteenth Amendment) Act, 2011 and the Constitution (First Amendment) Act, 1973 respectively. It is added that no person to whom the Act of 1973 applies shall have the right to move this Division for any of the remedies available under the Constitution other than the one provided in the Act of 1973. On the other hand, the learned counsel for the petitioner has submitted that the review petition is maintainable in view of Article 105 of the Constitution read with Order XXVI of the Supreme Court of Bangladesh (Appellate Division) Rules, 1998. (কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ৫-৬)
আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের (কমপ্লিট জাস্টিস) দাবি জানিয়েছিলেন৷ এ ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে আপিল বিভাগ তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে একটি ভারতীয় মামলার রেফারেন্স দিয়েছে৷ পুনম বনাম সুমিত তানবর (২০১০) মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছিলো যে, আইনের লঙ্ঘন করে ‘কমপ্লিট জাস্টিস' নীতির প্রয়োগ করা যাবে না৷ এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় নিলে বলা যায়, সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্পষ্ট বাধা থাকায় রিভিউ অনুমতির ক্ষেত্রে ১০৪ অনুচ্ছেদের কমপ্লিট জাস্টিস নীতির প্রয়োগ করা উচিত হবে না৷ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার আইনজীবী ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় এই মামলার রেফারেন্স দিতে গেলে আদালত পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ভারতে কি ৪৭ (৩) আছে?'
পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে: The Supreme Court of India in Poonam V. Sumit Tanwar, (2010) 4 SCC 460 held that in exercise of its powers for doing complete justice the court generally should not issue any direction to waive the statutory requirement. The courts are meant to enforce the law and therefore, are not expected to issue a direction in contravention of law or to direct the statutory authority to act in contravention of law. (কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ১৯)
আপিল বিভাগ তাদের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এটি স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছে, ৪৭ ক (২) ধারার উপস্থিতিতে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের সুযোগ নেই৷ পাশাপাশি এটিও উল্লেখ করা হয়েছে, দণ্ডিত আসামিকে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নয়৷ এ কারণে এই মামলায় আপিল বিভাগের রায় রিভিউ করার ক্ষেত্রে সংবিধানে ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ হবে না৷ এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৯৮৮ সালের রুলের প্রয়োগও হবে না৷
পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে: Article 104 of the Constitution will have no application in this case for, the Act of 1973 is a protected law. Clause (2) of Article 47A takes away the right to move the Supreme Court for any of the remedies under the Constitution to a person to whom a law specified in clause (3) of Article 47 applies. What's more, the right of appeal of a convicted person is given by the Act of 1973 and not by Article 103 of the Constitution. Therefore, if Article 103 is not applicable, Articles 104 and 105 will not also be applicable to review a judgment of this Division passed by it against the judgment of the Tribunal established under the Act of 1973. Naturally, the Supreme Court (Appellate Division) Rules, 1988 will also not be applicable. (কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ১৯-২০)
এই পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল৷ কিন্তু আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ হবে না উল্লেখ করেই ঠিক তার পরের অনুচ্ছেদে রিভিউ পিটিশন দাখিলের সময়সীমা নির্ধারণে যুক্তি দিয়েছে৷ রিভিউ পিটিশন দায়েরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ১৫ দিন৷
পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে: Now the question is whether what would be period of limitation for filing a review petition from the judgment of this Division passed against a judgment of the Tribunal set up under the Act of 1973. In the Act as observed above, the trial of a case before the Tribunal shall be held expeditiously without undue delay. Since the scheme and object of the law manifest that the proceedings shall be concluded expeditiously, the period of limitation for filing such review petition shall be as early as possible. As per rules of this Division review petitions shall be filed within thirty days but this period of limitation is not only inconsistent with the provisions of the Act but also not applicable. We are also not unmindful that the convicted person should be given a reasonable time to file a review petition. What is reasonable time is a matter to be considered in the context of the matter. There is no hard and fast rule in this regard. An aggrieved party can file a review petition against any order of the Tribunal within seven days as per Rules framed by it. In the courts of small causes a period of fifteen days limitation is provided for filing review petition from its judgment. This has been done with a view to secure finality of litigation. In some cases it has been observed that if this bar of time is not placed on the power of review it would mean that a judgment can never become final. Taking into consideration the surrounding circumstances it is our considered view that fifteen days' time will be a reasonable time. This will secure the ends of justice. (কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ২০-২১)
একদিকে বলা হলো সংবিধানের ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ হবে না, অন্যদিকে পরের অনুচ্ছেদেই রিভিউ পিটিশন দাখিলের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো! এই ব্যাপারটাই আমাদের বোধগম্য হয়নি৷
আইনে বিধান না থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের কথা বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ দিয়েছে৷ অথচ সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদ যুদ্ধাপরাধীদের এই সুযোগ দেয় না৷
পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে: Despite there being no provision in the Act of 1973 for review from the judgment of this Division on appeal, securing ends of justice a review is maintainable in exercise of the inherent powers from the judgment of this Division subject to the condition that where the error is so apparent and patent that review is necessary to avoid miscarriage of justice and not otherwise. (কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ২১-২২)
১১ ও ১২ ডিসেম্বর শুনানি চলাকালে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছিল, অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়৷ তাহলে পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদকে পাশ কাটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ করার সুযোগ দেওয়া হলো কেন? বিচারবিভাগের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেই এই প্রশ্নটি রাখতে চাই৷ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের প্রসঙ্গ কি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের জন্য? ভিকটিমের প্রতি কি ‘ন্যায়বিচারের' কোনো দায় নেই?
এখন কেউ কেউ উল্লেখ করছেন, রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ রায়ের ফলে রাষ্ট্রপক্ষেরও রিভিউ করার সুযোগ তৈরি হলো৷ তারা এটি ভুলে যাচ্ছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ করার সুযোগ আগে থেকেই ছিল৷ সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ-এর সুযোগ নেই, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তো এই অনুচ্ছেদ কোনো বাধা নয়৷ এ প্রসঙ্গে সাঈদীর আপিল মামলায় অবিলম্বে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ-এর দাবি জানিয়ে রাখছি৷
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করেছে৷ আসামিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশের যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচারের ক্ষেত্রে পায়নি৷ তারপরে আবার সংবিধানের স্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ করার অধিকার দেওয়া হলো৷ এর মাধ্যমে বিচারের প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হলো৷ আমাদের মনে রাখা উচিত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের ঋণ জড়িয়ে আছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড দিয়ে তা কার্যকরের মাধ্যমেই বাংলাদেশ হাটতে পারে ন্যায়বিচারের পথে৷
সংবিধানের ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা মূলত আপিল বিভাগের৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কিছু অন্তর্নিহিত ক্ষমতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ যদি আপিল বিভাগ মনে করে তাদের রায়ে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে, তাহলে এই ত্রুটি সংশোধনের অধিকার তাদের রয়েছে৷ এটি তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করতে পারে অথবা অন্য কোনোভাবে তাদের দৃষ্টিগোচর হলে তারা সেটি আমলে নিতে পারে৷ এখন প্রশ্ন হলো, আদালত তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য উম্মুক্ত করে রাখবে কিনা? তাছাড়া ১৯৭৩ সালে সংবিধানের ১ম সংশোধনীতে ৪৭(৩) ধারার সংযোজন এবং ২০১১ সালে সংশোধণও কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রশ্নেই করা হয়নি? সেটা মানা না হলে তার কী প্রয়োজন ছিল?
এটা স্পষ্ট যে, রিভিউ-এর যে সুযোগ আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে দেয়া হলো তা সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়াকে আরো দীর্ঘায়িত করবে৷ কেননা রিভিউ করতে হলে পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রয়োজন৷ স্বাধীনতার চার দশক পর যে বিচার করা হচ্ছে তা ইতোমধ্যেই বিচারহীনতার নজির স্থাপন করেছিল, যা আইনের শাসনের পরিপন্থি৷ এমনকি আপিল বিভাগের রায়েও দীর্ঘসূত্রিতার কথা উল্লেখ রয়েছে৷ বিলম্বিত বিচারের ফলে অনেক অপরাধীকেই তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করতে হয়নি৷ আজ যে বিচার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবার প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু হলো তাও যদি এভাবে বারবার বাধাগ্রস্থ হতে থাকে, তবে সেটাও হবে আরেক অবিচার৷
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে যখন ৩০ লক্ষ শহিদের চেয়ে মানবতাবিরোধীদের স্বার্থ রক্ষায় আদালতকে তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেখি, তখন মনে একটাই প্রশ্ন ‘রাষ্ট্র তুমি কার?'