রাশিয়ায় মানবাধিকার আন্দোলনের উপর চাপ
৪ মার্চ ২০২১গত বছর শীতের ছুটির ঠিক আগে আগে রাশিয়ার পার্লামেন্ট দ্রুত কয়েকটি নতুন আইন বলবৎ করে। তারই মধ্যে অন্যতম ছিল 'ফরেন এজেন্ট' আইন। এতদিন কেবলমাত্র নথিভুক্ত বিদেশি সংস্থা এবং সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ ছিল। নতুন আইনে ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তা প্রয়োগ করা যাবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি আন্দোলনে অংশ নিলে অথবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে দেখা হবে তার ফান্ডিং বিদেশ থেকে আসছে কি না। এলে, তার বিরুদ্ধে ফরেন এজেন্ট আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, নতুন আইন ঠান্ডাযুদ্ধের সময় ফিরিয়ে এনেছে। ওই সময়ে ব্যক্তির উপর এ ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি করা হতো। এর ফলে সমাজে বিভেদ তৈরি হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
আইনে নতুন দুইটি পরিবর্তন দেখে মনে হচ্ছে, মানবাধিকার কর্মী লেভ পোনোমারেভের কথা মাথায় রেখে তা করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে পোনোমারেভ সহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ফরেন এজেন্ট মিডিয়া আউটলেটের অভিযোগ আনা হয়। যা শুনে পোনোমারেভের প্রতিক্রিয়া, এর চেয়ে হাস্যকর অভিযোগ আর কিছু হতে পারে না। বাকি চার ব্যক্তির মধ্যে একজন নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বাকি তিনজন সাংবাদিক।
সোভিয়েত আমলে পোনোমারেভ প্রথম মানবাধিকার সংস্থা তৈরি করেছিলেন। সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়াতেও তার সংস্থা অত্যন্ত পরিচিত। ৭৯ বছরের এই বৃদ্ধ মস্কোর আরো দুই মানবাধিকার সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে গোটা রাশিয়া জুড়ে মানবাধিকারের আন্দোলন চালান। গত ২০ বছর ধরে তারা আন্দোলন করছেন। ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেন।
গোটা রাশিয়ার এক হাজার আন্দোলনকারী তার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে পোনোমারেভের দাবি। এবং সে কারণেই তাকে ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে মানবাধিকারকর্মীরা আর তার সংগঠনের ছাতার তলায় আসতে পারবেন না। এলে তারাও একই ভাবে ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
মঙ্গলবার পোনোমারেভ জানিয়েছেন, তিনি তার সংগঠন ভেঙে দিচ্ছেন। তার আন্দোলনও আপাতত বন্ধ রাখছেন। কারণ তার জন্য সমস্ত আন্দোলনকারী ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হোন, তা তিনি চান না। বস্তুত, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে অন্য আন্দোলনকারীদের জরিমানা দিতে হবে।
ডিডাব্লিউকে পোনোমারেভ অবশ্য জানিয়েছেন, তার সহকর্মীরা আগের মতোই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। ''আমি আমার সংগঠন ভাঙছি, যাতে আন্দোলনের কোনো ক্ষতি না হয়। আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে।'' ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন পোনোমারেভ।
লুকোচুরি খেলা
দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার প্রশাসনের সঙ্গে কার্যত লুকোচুরি খেলছেন এই আন্দোলনকারীরা। মানবাধিকার নিয়ে একের পর এক আন্দোলন করে প্রশাসনকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে তাদের মস্কোর অফিস তছনছ করে প্রশাসন। সেখান থেকে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে তাদের সংস্থাটিকে ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি পোনোমারেভকে এই প্রথম ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হলো নতুন আইনের সাহায্যে।
২০১৯ সালে রাশিয়ার সুপ্রিমকোর্ট পোনোমারেভের সংস্থাটিকে বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কেন বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এরপর পোনোমারেভ যে আন্দোলন শুরু করেন, তা কোনো সংগঠনের মাধ্যমে করেননি। একাধিক ব্যক্তিকে একত্রিত করে বিক্ষোভ শুরু করেন। যা কোনো রেজিস্টার্ড সংস্থার ব্যানারে হচ্ছিল না।
নতুন আইন এ ধরনের আন্দোলনেও বাধা তৈরি করতে পারে। কারণ, এখানে ব্যক্তিকে ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। ''আমাকে আটকানোর জন্যই প্রশাসন এ কাজ করেছে।'' ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন পোনোমারেভ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেনস সিগার্টের বক্তব্য, পোনোমারেভের বিরুদ্ধে প্রশাসনের এই আক্রোশের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তাকে আলাদা করে বেছে নিয়ে একটি গোটা আইন তৈরি করে ফেলা হলো, এ ঘটনা সত্যিই আশ্চর্যের। আন্দোলনকারীর সৎ ভাবমূর্তি এবং তার বিপুল জনপ্রিয়তাই সম্ভবত এই আক্রোশের কারণ।
আরো বড় আক্রমণ!
রাশিয়ার প্রায় সমস্ত মানবাধিকার সংস্থাই এখন ফরেন এজেন্ট। ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন আরেক মানবাধিকার কর্মী চারকাসোভ। তার সংস্থাটিকেও ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিগার্টের মতে, প্রায় সমস্ত মানবাধিকার সংগঠনকে ফরেন এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে রাশিয়ার প্রশাসন তাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। বহু সংগঠনের উপর বিশাল জরিমানার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিগার্টের আশঙ্কা, বিদেশি রাজনৈতিক ফাউন্ডেশনগুলিকেও কিছুদিনের মধ্যেই ফরেন এজেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে সেখানে কর্মরত ব্যক্তিদেরও ফরেন এজেন্ট বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে।
বিশ্বের বিরুদ্ধে রাশিয়া!
গত কিছু বছর ধরে রাশিয়ার সরকার এবং জাতীয় টেলিভিশন দেখানোর চেষ্টা করছে, বিশ্ব তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার উপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নাভালনির ঘটনার পরে আরো কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। রাশিয়া এই সবকিছুকেই তাদের উপর আক্রমণ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। আর এই সবকিছুকে সামনে রেখে তারা মানবাধিকারের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এ ভাবে মানবাধিকারের আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না। বরং তা আরো বাড়বে।
শেরউইন এমিলি/এসজি
LINK: http://www.dw.com/a-56755162