রাশিয়ার অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
ইউক্রেনে হামলার কারণে নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে রাশিয়া৷ দেশটি বলছে অর্থনীতিতে এর প্রভাব যতটা পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা পড়েনি৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে৷
নিষেধাজ্ঞার বহর
২২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়ার উপর ৮,২২৫টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিভিন্ন দেশ৷ আমদানি-রপ্তানি, ঋণ প্রদান, লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেয়াসহ নানা নিষেধাজ্ঞা ঝুলছে দেশটির উপরে৷ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করা কাস্টেলাম-এর হিসাবে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ২৬টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এরপর আছে সুইজারল্যান্ড, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান৷
রুবলের উল্লম্ফন
নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে দেশটির মুদ্রা দুর্বল হওয়ার বদলে শক্তিশালী হয়েছে৷ জানুয়ারির পর থেকে মে পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে রুবল ৪০ শতাংশ শক্তিশালী হয়েছে৷ জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, রাশিয়া থেকে আমদানি পণ্যের মূল্য রুবলে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে৷
বেড়েছে মূল্যস্ফীতি
জুনের হিসাবে এক বছর আগের তুলনায় রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতি বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ৷ তবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে যতটা মূল্যস্ফীতি হবে বলে ধারণা করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে বছর শেষে তা আরো কম হবে৷ যে কারণে মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ১৮ থেকে ২৩ শতাংশের বদলে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা৷
খরচ কমিয়েছেন ভোক্তারা
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কেনাকাটা কমিয়ে দিচ্ছেন রাশিয়ার মানুষ৷ পণ্যের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের হিসাব থেকে এমন তথ্যই মিলছে৷ গত এপ্রিলে যা ৫৪ শতাংশ কমেছে বলে রাশিয়ার দৈনিক কমারস্যান্টকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে রয়টার্স৷ ফেডারেল স্ট্যাটিস্টিকস সার্ভিসের হিসাবে একই মাসে খুচরা বিক্রি কমেছে ৯.৭ শতাংশ৷ ব্যবসা ও ভোক্তা ব্যয়ে ‘চাহিদা সংকট’ রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভও৷
প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে পরিবর্তন
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাশিয়ায় এপ্রিলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে তিন শতাংশ৷ মে মাসে দেশটির সরকার থেকে জানানো হয়েছিল চলতি বছর জিডিপি সাত দশমিক আট শতাংশ কমতে পারে৷ তবে অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভ সম্প্রতি বলেছেন, এই হার পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে৷ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের পূর্বাভাস, বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন কমায় জিডিপি কমবে ১৫ শতাংশ৷
আমদানি কমেছে অনেক
যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞায় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও শিল্প উৎপাদন কমায় রাশিয়ার আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে৷ রাশিয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংক ওটক্রিতির তথ্য দিয়ে দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, এপ্রিলে ৫০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে দেশটি৷ যেখানে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে সবশেষ মাসের আমদানি, রপ্তানি বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি৷
চাঙা জ্বালানি রপ্তানি
দ্য ইকোনোমিস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ্বালানি রপ্তানি থেকে এখনও দৈনিক ১০০ কোটি ডলার আয় করে চলেছে রাশিয়া৷ হেলসিংকিভিত্তিক দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিয়ার এয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন হামলার পর প্রথম ১০০ দিনে জ্বালানি রপ্তানি থেকে ৯৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে মস্কো৷ এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটির তেল রপ্তানি থেকে আয় ১২ শতাংশ বেড়েছে৷
গাড়ি বিক্রিতে ধাক্কা
অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোপিয়ান বিজনেসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাহিদা কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল সংকটের কারণে মে মাসে গাড়ি বিক্রি রেকর্ড ৮৩ শতাংশ কমেছে৷ রুশ পরিসংখ্যান দপ্তর রসস্ট্যাট-এর তথ্য অনুযায়ী, গাড়ির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ গাড়ি শিল্পের ক্ষতি কাটাতে প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে ১৬ জুন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুটিন৷
সার্বিক প্রভাব কতটা?
রুশ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘প্রথম প্রান্তিকের (অর্থনৈতিক) ফলাফল এবং এপ্রিল-মে মাসের পূর্বাভাস বলছে, যতটা খারাপ আশঙ্কা করা হয়েছিল পরিস্থিতি ততটা খারাপ হবে না৷’’ তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা সেন্ট পিটার্সবার্গের অর্থনৈতিক ফোরামে বলেছেন, বিদেশি চাপে রুশ অর্থনীতি যে চাপে পড়েছে, তা অনির্ধারিত সময় ধরে চলমান থাকার শঙ্কা রয়েছে৷ পরিস্থিতি আগের অবস্থায় আর ফিরবে না বলেও আশঙ্কা তার৷
প্রকৃত পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার প্রকৃত পরিস্থিতি কী সেটি এখনও পরিস্কার নয়৷ দীর্ঘমেয়াদে দেশটির অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে৷ বিশেষ করে রাশিয়া ছাড়ার ঘোষণা দেয়া বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিগুলো কর্মীদের বেতন দেয়া বন্ধ করলে তা মানুষের আয়ে প্রভাব ফেলবে৷ তবে কর্মসংস্থান, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ রেখেছে দেশটির সরকার৷