ভারতের দলিত প্রেসিডেন্ট কোবিন্দ
২০ জুলাই ২০১৭ইদানীং নতুন এক শব্দকে ঘিরে উত্তাল হয়েছে গোটা ভারত৷ শব্দটি ‘গো-রক্ষক'৷ গরু তাদের ‘মা', তাই কেউ নেহাৎ খাদ্যাভ্যাসের কারণে গরুর মাংস খেতে চাইলে তাকে মেরে ফেলো৷ তা-ও আবার জনসমক্ষে পিটিয়ে খুন করো৷ কেউ বংশানুক্রমিক জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে মৃত গবাদি পশুর চামড়া ও অন্যান্য জিনিসের ব্যবসা করতে গিয়ে ‘গো-হত্যা'র অভিযোগে ধৃত৷ প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমের পাতা জুড়ে হত্যার খবর প্রকাশিত হচ্ছে৷
গত কয়েক বছরে গরু-সহ ‘ধরা পড়ে' নির্মম মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে বেশ কিছু মানুষকে৷ তাঁদের অনেকেই সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির, ভারতে যাঁদের রাজনৈতিক নাম ‘দলিত'৷ হিন্দু-মুলসমান বিভেদের মতো এদেশের হিন্দু সমাজে আবার উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বিভেদও বেশ স্পষ্ট৷ দলিত, মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের শুধুমাত্র ভোটব্যাংক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ভারতের রাজনীতিকরা৷
দলিত শ্রেণি থেকে উঠে আসা ভারতের নতুন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ নাদিমুল হক বললেন, ‘‘রামনাথ কোবিন্দের পরিচয় এখন উনি ভারতের রাষ্ট্রপতি৷ দলিত পরিচয় মোটেই আর বড় নয়৷ আমরা আশা করব, অস্পৃশ্যতা ঘুচে যাবে৷ কিন্তু তা কতটা হবে সেটা দেখতে হবে৷ তবে আমার মনে হয়, গো-রক্ষার নামে যা ঘটছে সেটা একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা৷ একদল বলছেন এমনটা হওয়া উচিত নয়, হতে দেওয়া হবে না৷ তা-ও প্রতিদিনই দলিতদের গণহত্যা করা হচ্ছে৷ এর পেছনে রয়েছে রাজনীতি৷ একটা দাঙ্গা বাঁধিয়ে যদি ১০-১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা যায়, সহজ পথ হিসেবে সেটাই বেছে নেবে ওরা৷ আসলে সমাজকে বিভাজিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা৷''
সংসদে দলিত ইস্যুতে কথা বলতে দেওয়া হয়নি বলে রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী তথা দলিত নেত্রী মায়াবতী৷ বৃহস্পতিবারই তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহিত হয়েছে৷
শাসক দলের নেতারা মনে করেছেন, দলিত মুখ হিসেবে কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করা হলে জোড়া লাভ হবে৷ এক, বার্তা দেওয়া যাবে যে, বিজেপি গোটা হিন্দু সমাজকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছে৷ দুই, লোকসভা ভোটের আগে দলিত ও উচ্চবর্ণের ভোটকে এক ছাতায় আনা যাবে৷
লোকসভার সাংসদ তাপস মন্ডল জানাচ্ছেন, ‘‘দলিত রাষ্ট্রপতি হওয়াতে ভারতে দলিতদের অবস্থার খুব একটা যে উন্নতি হবে তা হলফ করে বলা যায় না৷ কারণ, এর আগেও কে আর নারায়নাণ ছিলেন৷ কোবিন্দকে বিভিন্ন সমাজের মানুষ নির্বাচিত করলেন৷ এটা একটা বার্তা দেওয়া যে, দলিতরা কোনও অংশেই ছোট নয়৷ কিন্তু, হাজার হাজার বছর ধরে দলিতদের যে চোখে দেখে আসা হয়েছে তা বদলাতে হলে আরও বেশি উদ্যোগের প্রয়োজন৷ একজন দলিতকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে হাত ধুয়ে ফেললে হবে না৷ তার জন্য অনেক বেশি পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার প্রয়োজন৷ রোহিত ভেমুলার মতো ঘটনার পরেও দলিত নির্যাতন থেমে নেই৷ সমাজ থেকে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি মুছে ফেলা সত্যিই ভীষণ কষ্টকর৷ তাছাড়া আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির কাজের পরিসর অত্যন্ত ছোট৷''
উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে দলিত নির্যাতন সবচেয়ে বেশি৷ বাদ নেই দক্ষিণের কয়েকটি রাজ্যও৷ দলিতকে অস্পৃশ্য করে রাখার ঘটনা রোজই সামনে আসছে৷ স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও দলিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ দলিত ছেলের সঙ্গে প্রেম করায় নিজের মেয়েকে পিটিয়ে খুন করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে৷ রাজনীতিগতভাবে উচ্চবর্ণের ভোট বিজেপি-র দখলে৷ গত তিন বছর ধরে বিজেপি কেন্দ্রের শাসক দল৷ ফলে, দলিত নির্যাতনের যাবতীয় দায় এসে পড়ে বিজেপির ঘাড়েই৷ বিরোধীরা অন্তত তেমনটাই বলছেন৷ গুজরাটের উনায় গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন কয়েকজন দলিত৷ গো-রক্ষকরা তাঁদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে৷ হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ছাত্র রোহিত ভেমুলা দিনের পর দিন অপমানিত হতে হতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন সেকথা৷
ছত্তিশগঢ়ের রামনামী সমাজের কাছে তাঁদের শরীরের ট্যাটু মন্দিরে ঢোকার ছাড়পত্র৷
মধ্যপ্রদেশের একটি ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা ভারতকে৷ দলিত পরিবার, বিবাহ বা আনন্দ অনুষ্ঠানে ব্যান্ড বাজানো কীসের? এমনই নিদান ছিল সেখানকার তথাকথিত উচ্চবর্ণের৷ মৌখিক নিদান অগ্রাহ্য করে বিয়ের আসরে ব্যান্ড বাজানোর আয়োজন করেছিল একটি পরিবার৷ তারপর ব্যবহার্য পানীয় জলের কুয়ো কেরোসিনের গন্ধে ভরে উঠল!
গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে মহারাষ্ট্রে খুন হয়েছেন খ্যাতনামা দলিত নেতা ও লেখক কৃষ্ণ কিরওয়ালে৷ কোলহাপুরের রাজেন্দ্রনগরে নিজের বাড়িতেই তাঁর রক্তাক্ত দেহ পাওয়া যায়৷ তদন্তে উঠে আসে, দলিত পরিচয়ই তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ৷ রোজ রোজ হামলা হয়, মানুষ বলে গণ্যই করে না সমাজের উচ্চবর্ণের লোকেরা৷ এই অবস্থা থেকে বাঁচতে ধর্ম বদলে নিল ১৮০টি দলিত পরিবার৷ উত্তরপ্রদেশের রুপদি, এগরি এবং কাপুরপুর গ্রামের ওই ১৮০টি দলিত পরিবার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছেন৷
রোহিত ভোমুলার পরেও থামেনি কলেজের হস্টেলে দলিত বলে র্যাগিংয়ের ঘটনা৷ সরকারি কলেজের হস্টেলে র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছে একদল ছাত্রকে৷ কেরলের কোট্টায়াম শহরের পলিটেকনিক কলেজের এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন৷ জানা গেছে, দলিত সমাজ থেকে আসার কারণেই ওই ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে৷
এমন পরিস্থিতেই রাষ্ট্রপতি হলেন রামনাথ কোবিন্দ৷ দলিত নেতা হিসেবেই তিনি পরিচিত৷ রাষ্ট্রপতি পদে রামনাথ কোবিন্দকে কেন প্রার্থী করল বিজেপি এবং এনডিএ? সূত্র জানাচ্ছে, ধর্মীয় মেরুকরণের পাশাপাশি এবার দলিত এবং ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককে একজোট করার জন্য দেশজুড়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিজেপি৷ উত্তর প্রদেশে দলের বিপুল জয়ের পরেও দলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ব্রাহ্মণ, তথা উচ্চবর্ণের হাতে থেকে যাওয়ার অভিযোগ খণ্ডন করতে পারছে না দল৷ সেই কারণে শুধুবিজেপিই নয়, সংঘ পরিবারের একটি অংশ দলিত কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার পক্ষে রায় দিয়েছে৷ কিন্তু, বিজেপির ভাগ্যে যা-ই জুটুক না কেন, শেষমেষ প্রশ্নটা থেকেই গেল – ঠিক কবে দেশ থেকে বিদায় নেবে অস্পৃশ্যতা?
বন্ধু, আপনার কী মনে হয়? ভারত থেকে কি অস্পৃশ্যতা সত্যিই বিদায় নেবে কোনোদিন? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷