রামকিঙ্করের ভাস্কর্যে খুঁত!
১৪ আগস্ট ২০১৭সবাই যেভাবে শিল্পকলাকে দেখেছে, তিনি সেই প্রথাগত নজরে দেখেননি৷ সেই কারণেই তিনি অনন্য, সেই কারণেই তিনি রামকিঙ্কর৷ শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্নেহে, প্রশ্রয়ে যাঁর শিল্পসত্ত্বার বিকাশ ঘটেছিল, যাঁর শিল্পকৃতি সম্পর্কে অভিযোগ ওঠায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ওকে ওর মতো কাজ করতে দাও, সেই রামকিঙ্কর বেইজের বিরুদ্ধে শিল্পবিকৃতির অভিযোগ৷
প্রশ্ন হলো কারা তুললেন? উত্তর-পূর্ব ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্য অসমের এক বিধায়ক এবং কিছু সরকারি কর্তাব্যক্তি৷ গুয়াহাটির সারানিয়া পাহাড়ের মাথায়, গান্ধী মণ্ডপের বাগানে বসানো আছে রামকিঙ্করের তৈরি এক গান্ধীমূর্তি৷ ওই মূর্তিটি রামকিঙ্কর শুরু করলেও শেষ করেননি৷ শেষ করেন তাঁর ছাত্ররা৷ এরপর ১৯৭০ সালে মূর্তিটি বসানো হয়৷ সেই মূর্তির খুঁত খুঁজে বের করেছেন গুয়াহাটির (পূর্ব) বিজেপি বিধায়ক সিদ্ধার্থনাথ ভট্টাচার্য৷ তিনি বলেছেন, মূর্তিটি দেখে মহাত্মা গান্ধী বলে মনে হয় না! মূর্তির হাত-পায়ের গড়ন ঠিক নয়, মুখটিও বিকৃত, আরও নানা অসঙ্গতি৷ ফলে ঠিক হয়েছে, সেই বিসদৃশ মূর্তিটি ভেঙে সরিয়ে, তার জায়গায় একটি মানানসই এবং সুদৃশ্য গান্ধীমূর্তি বসানো হবে৷
অবশ্য বিজেপি বিধায়কের জানা ছিল না যে, মূর্তিটি রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি৷ বস্তুত কামরূপ জেলা আধিকারিকদের যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে কেউই জানতেন না ঐ গান্ধীমূর্তির ভাস্কর কে৷ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য স্বপন দত্ত বলেছেন, ‘‘‘সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক৷ রামকিঙ্কর বেইজ আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের একজন৷ তাঁর মতো আর একজনও হবেন না৷ শান্তিনিকেতনেও তাঁর তৈরি ‘বুদ্ধ’ বা ‘সুজাতার’ মতো ভাস্কর্য আছে, যেগুলির আকৃতির সঙ্গে আদত মানুষগুলির মিল নেই৷ কারণ শিল্প মানে নিজের ভাবনার প্রকাশ৷ সেটাই শিল্প৷ জীবনের সঙ্গে মিল খোঁজা নয়৷’’
কিন্তু কী কারণে বিধায়ক এবং অন্য প্রশাসনিক প্রতিনিধিদের মনে হলো যে রামকিঙ্করের ভাস্কর্যে খুঁত রয়েছে? প্রখ্যাত ভাস্কর তাপস সরকার ডয়চে ভেলেকে জানালেন, রামকিঙ্করই ভারতের প্রথম ভাস্কর, যিনি ভাস্কর্যশিল্পকে অনুসারী, বা অনুকরণের শিল্প করে না রেখে, বিষয়বস্তুর মৌলিক ভাবনাটি মূর্ত করার দিকে নজর দিয়েছিলেন৷ তিনিই প্রথম ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় শিল্পরীতির থেকে সরে গিয়ে স্বকীয় ভাবনায় শিল্পকে মূর্ত করে তুলতে প্রয়াসী হন৷ ফলে তাঁর ভাস্কর্যের সঙ্গে অনেক সময়ই বাস্তবিক চেহারার মিল পাওয়া যায় না৷ গুয়াহাটির গান্ধীমূর্তিটি যেমন গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানের চেতনা ফুটিয়ে তুলতে গড়েছিলেন রামকিঙ্কর৷ তাই সেই মূর্তির হাত, পা অনেক পেশীবহুল, হাতের মুঠি অনেক বড় এবং হাতে ধরা ডান্ডাটিও গান্ধীজির ব্যবহৃত লাঠির তুলনায় অনেক শক্তপোক্ত৷ শুধু এই গান্ধীমূর্তি নয়, রামকিংকরের তৈরি ‘কলের বাঁশি’, বা ‘সাঁওতাল পরিবার’-এর মতো ভাস্কর্য, এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথের মূর্তিও রামকিঙ্কর গড়েছেন নিজের মতো করে, নিজস্ব অভিব্যক্তি মিশিয়ে৷
বন্ধু, প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷