‘সমাজের অন্য জায়গায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে’
১০ ডিসেম্বর ২০২১সার্বিক বিষয়টি নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ৷
ডয়চে ভেলে : বর্তমান সময়ের রাজনীতিকরা কতটা শিষ্টাচার মেনে চলছেন?
মহিউদ্দিন আহমদ : আদৌ মানছেন কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন৷ কারণ, অহরহ তারা যেসব কথা বলেন প্রকাশ্যে এগুলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে শোনাটাও একটা সমস্যা৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তারা যে ভাষায় গালাগাল করেন, গণমাধ্যমে আমরা যেটা দেখি, তা শুনতেই আমাদের লজ্জা হয়৷ আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, আমাদের নেতারা এই ভাষায় কথা বলেন৷
রাজনীতিবিদদের মধ্যে কী ধরনের শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখেন?
মানুষকে সম্মান না দেখানো, রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকলেই যে তাকে গালাগালি করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই৷ আমি যদি কোনো একটি দলের সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামি, তাহলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হবে রাজনৈতিক কর্মসূচী৷ জনগণের সামনে আমি ওটাই তুলে ধরবো যে, আমাদের প্রতিপক্ষের কর্মসূচির চেয়ে আমাদের কর্মসূচিটা এই এই কারণে ভালো৷ সুরাতাং আপনারা আমাদের সমর্থন করুন৷ সমালোচনার ক্ষেত্রে তো আমি রাজনীতি খুব একটা দেখি না৷ বরং ব্যক্তিগত গালাগাল, আক্রোশ, চরিত্র হনন এগুলোই হচ্ছে বেশি৷ এগুলো সবসময়ই ছিল৷ আগেও ছিল, এখন বেড়েছে৷ আগে গণমাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না বলে আমরা শুনতাম না৷ প্রচার পেতো না৷ এখন যেহেতু গণমাধ্যম সর্বব্যাপী এবং অনেক কিছু গণমাধ্যমে না এলে ফেসবুক, ইউটিউবের কল্যাণে আমরা জেনে যাই৷ ফলে অবস্থাটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে৷
আগেও কি রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন শিষ্টাচারের ঘাটতি ছিল?
আগেও ছিল, একটু কম ছিল৷ স্বাধীনতার পর থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতাগুলো অনেক সময় ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে গালাগালিতে নামতো৷ অনেকেই বলতো, টেনে নামাবো, হিঁচড়ে নামাবো, মুজিব তুমি গুন্ডামি ছেড়ে দাও- এই সমস্ত শ্লোগান তো হয়েছে৷ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও সব সময় শালীনতা বজাaয় রাখা হয়নি৷ এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজে প্রকাশ্যে পাবলিক মিটিংয়ে বলেছেন, ‘‘লাল ঘোড়া দাবড়ে দেবো৷'' সরকার প্রধানের মুখে এ ধরনের কথা শোভা পায় না৷ এগুলো ছিল৷ কিন্তু এটা আস্তে আস্তে অনেক বেড়েছে৷ তখন তো রাজনৈতিক বিভাজন এতটা ছিল না৷ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল৷ এখন যেহেতু রাজনীতির মাঠে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তারা বেশ শক্ত, এখন আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার চাইতে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে জনগণের সস্তা সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার পথটা বেছে নিয়েছি৷ সব জায়গায় এটা হচ্ছে৷ আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, রাজনীতিবিদ এবং সার্কাসের কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম৷ আমরা মি. বিন বা চার্লি চ্যাপলিনের মতো চমৎকার মানবিক গুণসম্পন্ন কৌতুক অভিনেতা এখন আর দেখি না৷ আমরা দেখি, রাজনীতিবিদরা যে সমস্ত কথাবার্তা বলছেন অত্যন্ত নিম্নমানের, রুচিহীন এবং অনেক কিছু তো ভাষায়ই প্রকাশ করা যায় না৷ দিনের পর দিন তারা এটা বলে যাচ্ছেন৷
রাজনীতিবিদদের শিষ্টাচার কেন প্রয়োজন?
শিষ্টাচার সমাজে সবারই প্রয়োজন৷ রাজনীতিবিদরা যেহেতু দাবি করেন, তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সরকার পরিচালনা করছেন, নীতি নির্ধারণ করছেন, ফলে দৃষ্টান্ত তো তাদেরই স্থাপন করতে হবে৷ সাধারণ মানুষ তো তাদের দেখেই শিখবেন৷ আমি যদি একজন ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ হয়ে উষ্কানিমূলক কথাবার্তা বলি, তাহলে আমার যারা ক্যাডার আছে, তৃণমূলে কর্মী আছে, তারা তো তাহলে আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে লাঠালাঠি করবে এবং প্রতিপক্ষকে গালাগাল করবে৷
রাজনীতিকরা শিষ্টাচারবর্জিত হলে সমাজে এর কী প্রভাব পড়ে?
সমাজটা নষ্ট হয়ে যায়৷ আমরা তো এ-ও দেখি, বিশেষ করে ফেসবুকে কেউ শিষ্টাচারবর্জিত কথাবার্তা বললে তার পক্ষে-বিপক্ষে লোক দাঁড়িয়ে যায়৷ যিনি শিষ্টাচারবর্জিত কথাবার্তা বলেন, তার পক্ষেও অনেকে দাঁড়িয়ে যান৷ সাফাই গেয়ে বলেন, ওমুক তো ওই সময় এই কথা বলেছিলেন৷ শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ ঠেকানোর জন্য কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক তৎপরতা আমরা দেখি না৷ বরং আমরা দেখি, একটা সংগঠনে একজন যত বেশি উগ্র কথা বলতে পারে, বেয়াদবি করতে পারে, যত বেশি আক্রমণাত্মক হতে পারে, তখন তার প্রমোশন হয়, সে পুরষ্কৃত হয়৷ এমন বহু উদাহরণ আছে৷
উল্টো উদাহরণও তো আছে৷ ডা. মুরাদ মন্ত্রীসভা থেকে বাদ গেলেন৷ লতিফ সিদ্দিকী বহিস্কার হয়েছিলেন৷ এগুলো কেন বাদ দিচ্ছেন?
লতিফ সিদ্দিকীকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছে সেটা আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না৷ তবে সর্বশেষ যেটা হয়েছে এই তথ্য প্রতিমন্ত্রী হুট করে ওইদিন যে এই কথাটা বলেছেন তা তো নয়৷ আমরা তো অহরহ অনেক মন্ত্রীর মুখেই এই ধরনের কথা শুনছি৷ নাম বলছি না, দুই জন মন্ত্রী প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে এসে একই কথা বলে যাচ্ছেন৷ এর মধ্যে সারবস্তু কিছু নেই৷ এগুলোকে আমি সমালোচনার বিধির মধ্যেও ধরি না৷ এর মধ্যে গালাগালি থাকে বেশি৷ আমার কাছে আশ্চর্য লাগে- এই লোক কীভাবে প্রতিমন্ত্রী হলেন!
আমাদের রাজনীতি কি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে? ফলে এ ধরনের সংকট বাড়ছে?
আসলে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে না, বরং রাজনীতিবিদরা বদলে যাচ্ছেন৷ আগে রাজনীতিবিদরা শুধু রাজনীতিই করতেন৷ অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো৷ তারা সহায় সম্পদ বিক্রি করে রাজনীতি করতেন৷ তারা মানুষের উপকারও করতেন৷ এখন একজন রাজনীতিবিদ যখন হাঁটেন, তখন তার আশপাশে ২০-৩০ জন সাঙ্গপাঙ্গ থাকে৷ তার ব্যাগ একজন ক্যারি করে, মোবাইল আরেকজনের হাতে থাকে, দুই-তিনজন গানম্যান থাকে৷ মনে হয় একজন বাদশা যাচ্ছেন৷ এটা সব সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেই আমরা দেখি৷ রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে এখন নামমাত্র পেশা হিসেবে রেখেছেন, বাস্তবে তারা ব্যবসা করেন৷ ব্যবসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারেন না৷
রাজনীতিকের মধ্যে লেখাপড়া বা পারিবারিক শিক্ষার অভাবের কারণেই কি শিষ্টাচারবর্হিভূত আচরণ করছেন অনেকে?
ওইভাবে ধরে বলা যাবে না৷ তবে শিক্ষা তো আমরা পারিবারিকভাবে প্রথমে পা৷ ইআমি আমার বাবা-মাকে যে ধরনের কথা বলতে শুনি শিশুকালে, সেগুলোই তো আমার মনে গেঁথে যায়৷ আমাদের সমাজে যে নারীবিদ্বেষী মনোভাব বা শিশুদের প্রতি নির্যাতন বা বয়স্কদের প্রতি অবহেলা- এগুলো আমরা ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবারে দেখে অভ্যস্ত৷ আমি যখন বড় হই তখন এটা আমার মধ্যে থাকে৷
রাজনৈতিক চর্চা থেকে আমরা কি সরে যাচ্ছি? এর ফলে কি নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে?
রাজনৈতিক চর্চা তো নেই আসলে৷ রাজনীতির কোনো বই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তো কোনো পাঠচক্র হয় না৷ এরা কোনো বই পড়ে না৷ পড়াশোনার চর্চাটা এদের মধ্যে নেই৷ এদের যে ছাত্র সংগঠন তারাও তো পড়াশোনা করে না, বরং লাঠিয়ালি করাই হচ্ছে তাদের কাজ৷ সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা যেখান থেকে আসার কথা ছিল, সেখান থেকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না৷ আমি বড় দলগুলোর কথা বলছি৷ তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা বা পাঠচক্র হয় বলে আমি শুনিনি৷
রাজনীতিকদের শিষ্টাচারবর্জিত আচরণ ভবিষ্যতৎ রাজনীতি এবং নতুন যারা রাজনীতিতে আসছে তাদের মধ্যে কী প্রভাব ফেলবে?
নতুন তো কেউ রাজনীতিতে আসছে না৷ যারা আসছে তারা পুরনো রাজনীতিবিদদের পরিবারের সদস্যরা৷ তাদের অনেকেই মা-বাবা মারা গেলে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হচ্ছেন৷ যারা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, তারা কেউ তাদের সন্তানদের ছাত্র সংগঠন করার কথা বলেন না৷ তারা রাজনীতি থেকে দূরেই থাকেন৷ এবং তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার নামে বিদেশে পাঠিয়ে দেন৷ পরবর্তীতে তাদের আসনটা শূন্য হলে সেখান থেকে উড়ে এসে তিনি নির্বাচন করেন৷ এমন অনেক উদাহরণ আছে৷
অনেকেই হুট করে রাজনীতিতে এসে অনেক ক্ষমতাধর হয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু যারা ছাত্র রাজনীতি করে রাজনীতিতে আসেন বা যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন, তাদের মধ্যে কি গুণগত কোনো পার্থক্য আপনি দেখেন?
পার্থক্য তো মূলত একটাই৷ সেটা হচ্ছে, কানেকশন৷ শীর্ষ নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যোগাযোগ থাকে, তাহলে সেটা হচ্ছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় সম্পদ৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকা এবং পেশিশক্তি৷ যারা রাজনীতিতে একেবারে নিঃস্বার্থ কর্মী, তাদের তো এই তিনটার কোনোটাই নেই৷ ফলে অনেকেই বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক, জিন্দাবাদ দিয়ে যাচ্ছেন৷ দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন৷ কিন্তু আখেরে তাকে ওই প্রবোধটুকুই দেওয়া হচ্ছে যে, তুমি তো আদর্শের জন্য রাজনীতি করছো৷ দুধের সরটা তো খেয়ে নিচ্ছে অন্যরা৷
শুধু রাজনীতিক নয়, সমাজের অন্য জায়গাগুলোতে কী শিষ্টাচার দেখেন?
অন্য জায়গায়ও শিষ্টাচারের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ আমাদের চরিত্র গঠনের জন্য পরিবারের বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখানেও আমরা যা দেখি তা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলি, এখানে শিক্ষক-রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ছাত্ররা যেমন লাঠালাঠি করে, শিক্ষকরাও তাই করে৷ শিক্ষকদের বিভিন্ন নির্বাচনের আগে তারা যে ধরনের নোংরা কথা বলেন বা চক্রান্ত করেন, তার সবই যদি জনসমক্ষে আসে, তাহলে মানুষ তাদের গায়ে থুথু দেবে৷
কীভাবে আবার রাজনীতিবিদদের মধ্যে শিষ্টাচার ফিরিয়ে আনা যায়?
এটা তো বিচ্ছিন্নভাবে হবে না৷ এটা আসতে হবে পরিবার ও স্কুল কলেজ থেকে৷ শিক্ষক এবং অভিভাকরা যদি যত্নবান হন তাহলে একটা পরিবর্তনের শুরু হতে পারে৷ আমাদের সমাজে সব জায়গায় দেখবেন, যেমন সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী এদের মধ্যে নানা ধরনের দলাদলি এবং এক দল আরেক দলকে গালাগালি করছে৷ এদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত৷ সুতারাং সব জায়গাতেই পরিবর্তন আসতে হবে৷ শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যদি এই পরিবর্তনটা দেখতে চান তাহলেও হতে পারে৷ তবে এর জন্য সময় লাগবে৷