রাজনীতির বেড়াজালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সব সময়ই সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ তারা সব সময়ই বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, মূলত সরকারকে খুশি করতে৷ এত কিছুর পরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের কখনও রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শোনা যায়নি৷ নিরবে কাজ করলেও মুখ খুলে কিছু বলেননি তাঁরা৷ তবে এখন শুধু কাজ নয়, রাজনীতিবিদদের মতো বক্তব্যও দিচ্ছেন তাঁরা৷ সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, বিরোধী দল থাকবে কিনা – তাও বলছেন পুলিশ-ব়্যাব প্রধানরা৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আইনে বলা আছে, কে কতটুকু কথা বলতে পারবেন৷ আইনে বাইরে যাওয়ার কারো কোনো সুযোগ নেই৷ যদি কেউ বলেন তাহলে তিনি তা নিজ দায়িত্বে বলবেন৷ তাই এখনকার ব়্যাব ও পুলিশ প্রধান যা বলছেন, তা তাঁরা নিজ দায়িত্বেই বলছেন৷ তবে তাঁরা যে সীমা অতিক্রম করে ফেলছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে৷ তাঁদের উচিত রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো বক্তব্য না দেয়া৷ তাঁরা জনগণের ইচ্ছ-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন৷ কিন্তু এখন যা ঘটছে তা দুঃখজনক৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন পুলিশ প্রধান ছিলাম তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিন্তু এরচেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না৷ তারপরও আমি বা আমার আগে-পরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন না৷''
বুধবার কুমিল্লায় ‘নাশকতা প্রতিরোধ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন' বিষয়ক মত বিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব়্যাব-এর মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘‘খুন করে ক্ষমতায় যাবেন? ‘শেইম, শেইম'৷ আপনারা নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ খুন করে ক্ষমতায় যেতে চান৷ আমরা সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের সমাজ থেকে বিদায় করবো৷ তাদের বিরুদ্ধে একাত্তরের পর আরেকবার একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে হবে৷ সেই যুদ্ধে আপনারা সাধারণ জনগণ আমাদের পাশে থাকবেন৷ চৌদ্দগ্রামে যারা যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা মেরে সাতজনকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিশোধ নেওয়া হবে৷ তারা (হামলাকারী) পাকিস্তানের দোসর৷''
একই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘একটি লাশ পড়লে এর পরিবর্তে দু'টি লাশ ফেলে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে৷'' তারপরও অবশ্য মহাসড়ক পাহারা দিতে তিনি স্থানীয় জনগণকে অনুরোধ জানান৷
এর একদিন আগে মঙ্গলবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গাবতলিতে শ্রমিকদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘‘সন্ত্রাসীর কাছে সরকার হার মানবে না৷ সরকার যদি এদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে৷ আর তারপর আওয়ামী লীগও একই কাজ করবে৷''
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ বা ব়্যাব প্রধান যে ভাষায় কথা বলছেন, সোটা প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারীর ভাষা নয়৷ তাঁরা আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো করে কথা বলছেন৷ এটা একেবারেই ঠিক নয়৷ রাজনীতি আর প্রশাসন এক হয়ে গেলে দেশের সামনে ভয়াবহ খারাপ উদাহরণ হয়ে যাবে৷ কিছুদিন পরে দেখা যাবে সচিবরাও রাজনীতির ভাষায় কথা বলছেন৷ তাতে আমলাতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না৷ সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পর রুদ্ধ হয়ে যাবে৷''
তাই তিনি পুলিশ ও ব়্যাব প্রধানদের রাজনীতির ভাষা ছেড়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলার অনুরোধ করেন৷ হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে ব়্যাব মহাপরিচালক রংপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকবে৷ এটা কি তাঁর বলার কথা? কে কতদিন ক্ষমতায় থাকবে সেটা রাজনীতিবিদরাই ঠিক করবেন৷ তিনি কেন এটা করছেন?''
হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘‘রাজনীতিবিদরা এখন যে আচরণ করছেন, তা হয়ত এক সময় বদলে ফেলবেন৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামো একবার ধ্বংস হয়ে গেলে সেটা কিন্তু আর ঠিক করা যাবে না৷ ফলে সরকারের ঊর্ধতনদের উচিত পুলিশ ও ব়্যাব প্রধানকে সতর্ক করা৷ না হলে সামনে আরো খারাপ সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷''