রাজনীতির কুনাট্যে গুরুং কুশিলব মাত্র
২২ অক্টোবর ২০২০এ তো বলিউডের সিনেমাকেও হার মানিয়ে দেয়।
তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। তাঁকে দেখতে পেলেই গ্রেপ্তার করার নির্দেশ বহাল। গত তিন বছর ধরে বিমল গুরুং-এর পরিচয় হলো, তিনি পলাতক অভিযুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইন ইউএপিএ-তে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারায় গ্রেপ্তার হলে জামিন পাওয়া খুবই মুসকিল। আইনানুসারে তাঁকে রাজ্যের কোথাও দেখলেই গ্রেপ্তার করতে হবে। পুলিশ ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিক হত্যার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে।
এ হেন বিমল গুরুং বুধবার বিকেলে চলে এলেন কলকাতায়। ঝাড়খণ্ডের নাম্বার প্লেট লাগানো একটি গাড়িতে। সল্টলেকের গোর্খা ভবনে। তখন ভবনের গেট বন্ধ। যে পুলিশের তাঁকে গ্রেপ্তার করার কথা, তাঁরাই গেট খুলে গুরুংদের সেখানে রাখার জন্য প্রচুর চেষ্টা চরিত্র করলেন। গেট খুলল না। তাঁরা মধ্য কলকাতার একটি হোটেলে গিয়ে উঠলেন। তারপর ২৪ ঘণ্টাতেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো না। কারণ, তিনি তো দলবদল করে নিয়েছেন। ফলে তৃণমূলে তাঁর জামাই আদর। আর গত তিনবছর ধরে বারবার বিমল গুরুং-এর রক্ষাকর্তা বলে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিজেপি রাতারাতি বিমলের বিরুদ্ধে।
ফলে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শুরু হয়ে গেল এক অদ্ভুত চাপানউতোর। রাতারাতি তৃণমূল ও বিজেপি-র নেতাদের অবস্থান ও সুর বদলে গেল। গত ছয় বছরে এই ধরনের উদাহরণ দেশজুড়ে যে আমরা দেখিনি তা নয়। কংগ্রেস বা অন্য দলে থাকলে যে নেতারা জনশত্রু, বিজেপি-তে এলে তাঁরাই গঙ্গাজলে ধুয়ে পবিত্র হয়ে যান। যে রাজনৈতিক দলগুলি বিজেপি-র সঙ্গে থাকার জন্য সাম্প্রদায়িক, তারাই বিরোধীদের সঙ্গে এসে গেলে রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়। শিবসেনা পর্যন্ত। যে নেতারা দাঙ্গায় আসলে উস্কানি দিয়েছেন বলে সকলে দেখেন. শোনেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নয়, চার্জশিটে নাম পাওয়া যায় অন্যদের। কারণ, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা। তার মানে ক্ষমতায় যে দল থাকে, তাদের সঙ্গে এসে গেলে নেতারা, কর্মীরা আইনের উপরে চলে যান? যেমন গেলেন বিমল গুরুং? অন্তত এই কপি লেখা পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি রাজ্যের পুলিশ।
এই অবস্থায় শাহরুখ খানের মতো দুহাত ছড়িয়ে বিমল গুরুং যদি বলতেন, তাঁকে ধরা নামুমকিনই নয়, অসম্ভব, তা হলেও কিছু বলার ছিল না। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বরং তিন বছর পর কলকাতায় উদয় হয়ে বিমল গুরুং জানালেন, তিনি দল বদল করেছেন। তিনি এ বার চলে এসেছেন তৃণমূলের সঙ্গে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তৃণমূলকে সমর্থন করবেন। বিজেপি-কে নয়। কারণ, মোদী-শাহ কথা রাখেননি। গোর্খাল্যান্ড দেননি। আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরকম নন। তিনি কথা বললে কথা রাখেন। তাই তাঁর এই ডিগবাজি। তিনি গোর্খাল্যান্ডের দাবি ছাড়ছেন না। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে যে দল তাঁর দাবি সমর্থন করবেন, তাঁদের সঙ্গে তিনি যাবেন।
রাজনীতির সঙ্গে কেন যে এখনো নীতি কথাটা জুড়ে আছে কে জানে। এতদিনে আর কারো জানতে বাকি নেই, রাজনীতির একটাই নীতি, ক্ষমতা চাই। তার জন্য ভোটে জয় চাই। সেটা যে ভাবেই হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। তাই রাজনীতির অপরাধ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার পর দলগুলি বাহুবলী ডনদের প্রার্থী করতে দ্বিধাবোধ করে না। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা নেতারাও অনায়াসে প্রার্থী হতে পারেন। দল ক্ষমতায় থাকলে সাত খুন মাফ। তখন যেন যা খুশি করার অধিকার জন্মে যায়। কখনো গুড়-বাতাসা, কখনো চড়াম চড়াম বোলের বাদ্যি তুলে ভোট জিতে নেয়া যায়। আর ভোট যখন আসে, তখন নীতিটা হলো, যে ভাবে সম্ভব জিততে হবে। সেই অঙ্কে বিমল গুরুং তো রীতিমতো লোভনীয় সওদা।
কারণ, তাঁর ডিগবাজির অর্থ হলো দার্জিলিং পাহাড়ের তিনটি বিধানসভা আসন তৃণমূলের পকেটে চলে আসা। আর সমতলের গোটা পাঁচেক আসনে জয়ের সম্ভবনা তৈরি হওয়া। উত্তরবঙ্গে এ বার তৃণমূলের ভরাডুবির আশঙ্কা করছেন দলেরই বেশ কিছু নেতা। সেই জায়গায় গোটা আটেক আসন হাতের কাছে চলে আসার সম্ভাবনা কে ছাড়ে? তাই পলাতক অপরাধীও স্বাগতযোগ্য হয়ে যান। তৃণমূলের বিবৃতি দিয়ে গুরুংয়ের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা তাঁকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করতো। তা হলে তাঁর অপরাধের কি হলো? শান্তিরক্ষার অঙ্গীকার করা মানেই কি আগের অপরাধ ধুয়ে যাওয়া? না কি, এটাই মেনে নেয়া, আগের মামলা ছিল রাজনৈতিক?
রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেছেন, ''বিমল গুরুং-এর বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে মামলা আছে, পুলিশ অফিসারকে হত্যার অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আছে, তিন বছর ধরে তিনি পলাতক। একজন খুনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, সহযোগিতা করছে। কেন?'' প্রশ্নটা হলো, এই খুনে অভিযুক্ত ব্যক্তির হাত বিজেপি তা হলে কেন ধরে রেখেছিল? পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বিমল গুরুং এর সমর্থনেই তো জিতেছে বিজেপি। কেন?
রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, আমরা গোর্খাল্যান্ডের প্রতিশ্রুতি দিইনি। সায়ন্তন বলছেন, মমতা জানান, তিনি কি বাংলা ভাগের কথা মেনে নিয়েছেন? এই গোর্খাল্যান্ডের প্রসঙ্গ বিজেপির ইস্তাহারে স্থান পেয়েছিল। তখন তা হলে তারাও বাংলা ভাগ মেনে নিয়েছিল? কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তুলতে পারে? আদৌ এই প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার আছে তাদের?
ওই যে বললাম, নীতি তো একটাই, আমার সঙ্গে থাকলে ভালো, আমার বিরুদ্ধে গেলেই তার থেকে খারাপ লোক হয় না। বিমল গুরুংকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সার্কাসের নীতিকথা তো ওটাই। প্রশ্ন হলো, তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলার কী হবে? পুলিশ ইন্সপেক্টরকে হত্যার কী হবে? ইউএপিএ-র কী হবে?
আসলে এতসব প্রশ্ন করার অর্থ হয় না। আমরা তো মেনেই নিয়েছি, রাজনীতিতে সবই হয়। সব সত্যি। কংগ্রেস, আরজেডি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে ভোটে জিতে আসার এক বছরের মধ্যে সেই বিজেপি-র সঙ্গে রাতারাতি হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করতে পারেন নীতীশ কুমার। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে কাশ্মীরে সরকার গঠন করে কিছুদিন পর বেরিয়ে এসে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রচার শুরু করে দেয়া যায়। যে দলের বিরুদ্ধে রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা জড়িত, তাদের সঙ্গেই অনায়াসে হাত মেলাতে পারে কংগ্রেস। তেমনভাবেই বিমল গুরুং এর সঙ্গে জোট বাঁধে তৃণমূল।
আর রাজনীতিতে সবই হয় বলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চলে যায় জনগণ।