রাখাইনে হিন্দুদের গণকবরের ছবি
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একটি গণকবর খুঁড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মোট ২৮টি মরদেহ উদ্ধার করেছে৷ মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, ‘‘রবিবার পাওয়া এসব লাশের মধ্যে ২০টি নারীদের এবং বাকি আটটি পুরুষ ও শিশুদের৷''
স্থানীয় এক পুলিশ কমকর্তা এএফপিকে জানান, ‘‘সরকারের তথ্য কমিটির সরবরাহকৃত ছবিতে দেখা যায়, গণকবরের পাশে মরদেহগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে৷'' তবে কোনো সংবাদমাধ্যমের পক্ষেই ছবিগুলো স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়নি৷
মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই ঘটনায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ বা আরসা)-কে দায়ী করা হয়েছে৷ মিয়ানমার সরকারের দাবি, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এক শরণার্থী মিয়ানমারের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় গ্রাম ইয়ে বাও কিয়ার কাছে তল্লাশি চালানো হয়৷ সে সময় ওই গণকবরের সন্ধান মেলে৷ মিয়ানমার সরকারের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ওই শরণার্থী তাদের জানিয়েছেন, আরসা-র প্রায় ৩০০ জঙ্গি তাঁদের গ্রামে প্রবেশ করেছিল৷ হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ১০০ জনকে ধরে গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে তারা৷
ইয়ে বাও কিয়া গ্রামের যেখানে মরদেহগুলো পাওয়া গেছে সেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্পদ্রায়ের মানুষের বসবাস৷ সেই এলাকার নাম খা মং সেখ৷ গত সপ্তাহে এই এলাকার হিন্দুরাই এএফপিকে বলেছিলেন, ‘‘‘আরসা সদস্যরা ২৫ আগস্ট লাঠি ও ছুরি নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং সামনে পড়া সবার ওপর আক্রমণ করতে থাকে৷তারা হিন্দু নারীদের অপহরণও করে৷''
তবে মিয়ানমার সেনাবহিনীর এই তথ্য কোনো সংবাদমাধ্যমই স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি৷ কারণ, রাখাইনে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষধোজ্ঞা আরোপ করেছে মিয়ানমার৷
এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)৷ তাদের দাবি, তারা বেসামরিকদের ওপর কোনো হামলা চালায় না এবং কোনো হিন্দুকে হত্যাও করেনি৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক অডিওবার্তায় আরসার মুখপাত্র দাবি করেন, ‘‘বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করতে চাইছে৷ এ জন্য তারা আরসা সদস্যদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে৷ আরসা কোনো অবস্থাতেই বেসামরিক ও সাধারণ মানুষদের টার্গেন করবে না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ৷''
এদিকে গত ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং হরি মন্দিরের কাছে আশ্রয় নিয়েছে রাখাইনের মংডু থেকে পালিয়ে আসা প্রায় পাঁচশ' হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ তাঁরা রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব জেলার মংডুর চিকনছড়ি, ফকিরা বাজার , সাহেব বাজার, পুরান বাজার ও রিক্কাপাড়াসহ কয়েকটি এলকার বাসিন্দা৷ আশ্রয় নেয়া কয়েক জন এর আগে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ২৭ আগস্ট ওইসব এলাকায় হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৮৬ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করা হয়৷
পালিয়ে আসা চিত্তরঞ্জন কর ডয়চে ভেলেকে এই মাসের প্রথম সপ্তাহে জানিয়েছিলেন, ‘‘যারা হামলা করেছে তারা মুখোশধারী৷ শুধু চোখ ছাড়া পুরো শরীর কালো পোশোকে ঢাকা ছিল৷ তারা বার্মিজ এবং মংডুর স্থানীয় দুই ভাষায়ই কথা বলে৷ তাদের কারো পরনেই বার্মার সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল না৷''
সোমবার রাখাইন থেকে আসা হিন্দুদের কয়েকজন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যেখানে হিন্দুদের গণকবর আবিষ্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমাদের এলাকা নয়৷ তবে ওই এলাকার কথা আমরা জানি৷'' জগদীশ পাল বলেন,‘‘ গণকবরের এলাকাটি ফকিরা বাজারের পরে৷ আমার মা এখনো রাখাইনে আছেন৷ তিনিও গণকবরের কথা শুনেছেন৷ রাখাইনে থাকা আমাদের কয়েকজন হিন্দু নেতা সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গণকবর থেকে মরদেহ উদ্ধার করেছেন৷''
তিনি জানান, ‘‘আমরা ফেসবুকসহ নানা মাধ্যম থেকে ওই গণকবরের ও মরদেহের ছবি ডাউনলোড করেছি৷ তবে সেই ছবিতে কাউকে চেনা যায় না৷ মরদেহ পচে বিকৃত হয়ে গেছে৷ তাই আমাদের পরিচিত সেখানে কেউ আছে কিনা তা বুঝতে পারছি না৷'' জগদীশ পাল আরো বলেন, ‘‘আমরা গতকালই(রবিবার) গণকবর এবং মরদেহের ছবি পেয়েছি৷''
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই হিন্দু শরণার্থীদের দেখভাল করছেন কুতুপালং হরিমন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেসবুক ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমো-র মাধ্যমে এই ছবি এখন এখানকার অনেকেই পেয়েছেন৷ এখানে আশ্রয় নেয়া হিন্দুরা ওই এলাকার না হলেও তাঁরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় আছেন৷ তাঁরা গতকালই (রবিবার) ছবি পেয়েছেন৷ মিয়ানমার থেকে তাঁদের কাছে ছবি পাঠানো হয়৷ মরদেহের ছবি, কবরের ছবি৷ আমি অনেকের কাছেই মোবাইল ফোনে ওই ছবি দেখেছি৷ গলা কাটা ছবিও আছে৷ তবে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চেনা যায় না৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমারের যে এলাকায় গণকবরের কথা বলা হচ্ছে, সেখান থেকেও হিন্দুরা পালিয়ে কক্সবাজারে এসেছে বলে শুনেছি৷ তবে এই এলাকায় তাঁরা নাই৷''
রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান কি কোনোদিনই হবে না? লিখুন নীচের ঘরে৷