রাইনে খুঁজি পায়রা নদীকে
১৫ মে ২০১৮প্রবাস কখনো আমাকে সেভাবে টানেনি৷ পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য গেল কয়েকবছরে কয়েকটি দেশে ভ্রমণ ও কিছুটা সময় থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ এক একটি দেশে থেকেছি সর্বোচ্চ তিন মাস৷
কিন্তু একটু লম্বা সময়ের জন্য এবারই প্রথম এলাম জার্মানিতে৷ তাই এবারের অভিজ্ঞতা আগের সবগুলোর থেকে ভিন্ন৷ মধ্য ইউরোপ বলতে আসলে জার্মানিকেই বোঝায়৷ এর পূর্বে এক রকম৷ পশ্চিমে আরেকরকম৷ সেই প্রাচীনকাল থেকেই ব্যাপক অভিবাসন হয়েছে এ অঞ্চলে৷ তাই এক দেশেই মানুষে মানুষে, সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই৷
বৈচিত্র্য আছে এখানকার আবহাওয়াতেও৷ কেউ কেউ বলেন, একই দিনে চার ঋতু (এখানে চারটি ঋতু) দেখার অভিজ্ঞতা কেবল জার্মানিতেই সম্ভব! অবশ্য আমি নিজেই প্রমাণ পেয়েছি৷ একদিকে তুষারপাত হচ্ছে, সেইসঙ্গে কড়া ঝকঝকে দুপুরের রোদ৷ একটু পরই বৃষ্টি৷ আর হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস৷
এমন মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রথমবার যখন জার্মানিতে এসেছি তখনও৷ সেটি গত বছর জুনে৷ বিমান থেকে নেমেই দেখি ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা৷ আমাকে বিমানবন্দর থেকে নিতে এসেছিল যে বাহনটি, তাতে করে আমার জন্য নির্ধারিত অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাতে লেগেছে বড় জোর ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট৷ আমি তো গাড়িতে ওঠার সময় গরম কাপড় সব ব্যাগে ঢুকিয়ে বেশ ‘সামার অ্যাটিটিউড' নিয়ে পৌঁছালাম৷ গাড়ি থেকে নেমেই টের পেলাম কী ভুলটাই না হলো! তাড়াতাড়ি জ্যাকেট বের করে আবার পরতে হলো৷ কারণ আকাশ একটু মেঘলা হয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা নেমে গেছে দশের কাছাকাছি৷
এখানে সবাই আবহাওয়ার অবস্থা দেখে ঘর থেকে বের হয়৷ সারাদিনে কত তাপমাত্রা থাকবে, বৃষ্টি হবে কিনা, শীতের সময় বরফ পড়বে কিনা এ সব৷ তবে ঋতু পরিবর্তনের সময় বিষয়টি একটু জটিল৷ কারণ তাপমাত্রা হয়ত দেখাচ্ছে, সারাদিনে ১৬ থেকে ২২ থাকবে৷ কিন্তু বিকেলের দিকে হঠাৎ করে ‘অনুভূত তাপমাত্রা' বেজায় কমে গেল৷ কী বিপদের কথা!
অবশ্য এখানকার অধিবাসীরা আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন৷ গত বছর গ্রীষ্মেই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হামবুর্গ যাচ্ছিলাম৷ আবহাওয়া খারাপ ছিল৷ প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস৷ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি প্ল্যাটফর্মে৷ আর মাঝারি সাইজের একটি জ্যাকেট পরেও শীতে কাঁপছি৷ হঠাৎ দেখি, কয়েকজন তরুণ পাতলা টি-শার্ট আর শর্টস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ আমার মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বেরিয়ে পড়ছিল৷ দু'হাত দিয়ে মুখ চেপে সামাল দিলাম৷
এখানে যে বিষয়টিতে আমার বিরক্তি, তা হলো কাগজপত্রের খুব বাড়াবাড়ি৷ সব কিছুতেই কাগজপত্র লাগে৷ ডকুমেন্টস ছাড়া কেউ মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করবে না৷ এই বিরক্তির কারণ আমার এতদিনের অভ্যাস৷ কাগজপত্রের বালাই বাংলাদেশেও আছে৷ কিন্তু এখানে অনেক বেশি৷ এত পেপারওয়ার্কের কারণে এদের সুবিধাও হয়েছে৷ খুব সহজেই একজন নাগরিক বা অভিবাসীর সব তথ্য প্রমাণ তারা জোগাড় করে ফেলতে পারে৷ সেই সঙ্গে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজটিও সহজ হয়৷
আরও বিরক্তি, কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়৷ এমনকি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে গেলে, কিংবা ডাক্তার দেখাতে গেলে৷ ডাক্তার দেখাতে আমাদের দেশেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়৷ কিন্তু এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মানে অনেক দিনের অপেক্ষা৷ বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে৷ তাই অনেকেই যেটি করেন, প্রয়োজন না থাকলেও সারা বছর কয়েকজন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখেন৷ কে জানে, কোনটার দরকার পড়ে যায়!
আমার সবচেয়ে বড় আপত্তির কথা এখানে কাছের লোকেরা খুব জানেন৷ তা হলো, খাবার৷ বাঙালির রসনায় সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে থাকা একটা মানুষ যখন হঠাৎ করে ভিন্নস্বাদের আলুসেদ্ধতে মন বসাতে চায়, তখন তা চামচের আগাতেই পড়ে থাকে৷ বড় জোর পেটে পড়ে৷ মন ভরে না৷
তাই জীবনভর মা বোনদের ওপর চড়ে বসে রসুঁইঘরের চার দেয়ালের বাইরের জীবনকে উপভোগ করা এই আমি এখন নিয়মিত রান্নাবান্নায় মনোনিবেশ করছি৷ পাঁচবাড়ির লোকেরাও খেতে আসেন কখনো সখনো!
খাবার নষ্ট করা আমার মতো অনেকেরই বাতিক আছে৷ জার্মানরা কিন্তু খাবার নষ্ট করেন না৷ এই অভিজ্ঞতা আমার বেশ ভালো লেগেছে৷ জার্মানি অনেক ধনী দেশ৷ তাদের বছরে মাথাপিছু আয় গড়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকা৷ কিন্তু এদের কাউকেই কখনো দেখিনি খাবার নষ্ট করতে৷ কিংবা হিসেব করার সময় এক সেন্টও কম বেশি করেন না৷
আমি যে শহরটিতে থাকি, তার নাম বন৷ একসময় পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ছিল এই শহরটি৷ কিন্তু এখনকার সময়ে কোলন, বার্লিন, হামবুর্গের মতো জার্মানির বড় বড় শহরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে একে মফঃস্বল বা গ্রাম-মফঃস্বল বলাই ভালো৷
আমি কয়েকটি বড় শহরে গিয়েছি৷ কিন্তু বনই আমার ভালো লাগে৷ ঢাকার মতো বিরাট মহানগরীর কোলাহল, ছুটোছুটি, ট্র্যাফিক জ্যাম থেকে হুট করে বেরিয়ে একেবারে শান্ত-নিবিড় এই শহর আমার এই প্রবাসের নিঃসঙ্গতাকে কোনোভাবেই বাড়িয়ে তোলেনি৷ বরং এক রকমের প্রশান্তি পাওয়া যায়৷ অবশ্য তার কারণও আছে৷
আমি যে ঘরটিতে থাকি, তার জানালা দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়৷ পাহাড় আমার গলির ধারে৷ উলটোদিকে দু'কদম এগুলেই নদী৷ নাম তার রাইন৷ এই নদীটির ভালোই প্রভাব পড়েছে আমার ওপর৷ স্রোতস্বিনী রাইনের চঞ্চলতা আমার মন ভালো করে দেয়৷ মনে করিয়ে দেয় সেই পায়রা নদীর কথা৷ একেবারেই শিশুস্মৃতি বলতে যা বোঝায় বরগুনার আমতলীর সেই পায়রা নদীর উথাল পাথালের সঙ্গে রাইনের এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলার মিল খুঁজি আমি৷
সুইস আল্পস থেকে শুরু হয়ে এই নদী সুইস-লিস্টেনস্টাইন, সুইস-অস্ট্রিয়া ও সুইস-জার্মান সীমান্ত ঘেঁষে ফ্রান্স-জার্মান সীমান্ত ও জার্মানির রাইনল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডস হয়ে নর্থ সি-তে শেষ হয়েছে৷ জার্মানির ভেতর যতটা রাইন দেখেছি, আমার কাছে আমার বাড়ির পাশের রাইনই সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়েছে৷
সে যাই হোক, অল্প সময়ের অভিজ্ঞতা হলেও অল্প পরিসরে লিখে শেষ করতে পারছিনা বলে সংকোচবোধ হচ্ছে৷ তবে শেষ করার আগে আরেকটা প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই৷ বিষয়টি শুধু বন নয়, পুরো জার্মানির জন্যই প্রযোজ্য৷ তা হলো এখানকার শরণার্থী সংকট৷ এই সংকট এখানকার সমাজ বাস্তবতার ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছে৷ ‘ভিন্ন'দের প্রতি জার্মানদের ভালোবাসা যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি বিতৃষ্ণা ও বিরক্তি৷ এই দুই ধারার মধ্যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধও অন্তর্নিহিত আছে বলে মনে হয়েছে৷ সে কারণেই উগ্র জাতীয়তাবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এখানে৷ এই যুদ্ধে কে জয়ী হবে জানি না, তবে ভিন্নদের প্রতি মানসিকতার ওপর এর প্রভাব থাকবেই৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷