রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা, ‘মুক্তধারা’ এবং গান্ধী
১২ অক্টোবর ২০১১বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কবিতা রচনা করেছিলেন এবং পথে নেমে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন একের পর এক দেশাত্মবোধক গান৷ যেমন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল...'৷
আর এহেন গানে অথবা কোনো কোনো কবিতার মধ্যেই স্বদেশীরা খুঁজে পেয়েছিলেন দেশের জন্য আত্মদানের উদ্দীপনা৷ যদিও, অসহযোগ আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধীকে লেখা খোলা চিঠিতে অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন কবি৷ তাঁর লেখনী থেকে উঠে এসেছিল, ‘‘আপনার শিক্ষা বিধাতার সাহায্য নিয়ে অহিংসার পথে লড়াইয়ের শিক্ষা৷ কিন্তু, এমন লড়াই শুধু নায়কদের জন্য সম্ভবপর, সাধারণের জন্য নয়৷ সাধারণ মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয় বারবার৷ তাই, অন্যায়ভাবে সে উদ্যম প্রতিহত হলে অপমানজনক সন্ত্রাস আর হিংসা সহজেই সেই লড়াইয়ের পথ হয়ে উঠতে পারে৷''
গান্ধী ও কবিগুরুর কাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকলেও, গান্ধীর দর্শন টানতো রবীন্দ্রনাথকে৷ আর কবিকেও অসম্ভব শ্রদ্ধা ভরে দেখতেন মহাত্মা৷ তাই ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড দু'জনকেই মর্মান্তিক আঘাত করেছিল৷ ঘটনাটির প্রতিবাদে, ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘স্যার' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ তারপর ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপ থেকে ফিরে, কলকাতায় তিনি প্রায় চার ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন গান্ধীর সঙ্গে৷ অনেকের মতে অবশ্য, ঐ দুই মহাপুরুষের মধ্যে সেই দীর্ঘ আলোচনায় বিশেষ কোনো ফল হয় নি৷ কারণ তার পর-পরই, অসহযোগ আন্দোলনের ইন্ধন সন্ধানে বের হন গান্ধীজি৷ এবং রবীন্দ্রনাথ মন দেন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে৷
তবে গান্ধীর সঙ্গে সেই বৈঠকের কয়েক মাস পরেই ‘মুক্তধারা' রচনা করলেন কবিগুরু৷ ১৯২২ সালে লেখা এই নাটকটি ‘রূপক-সাংকেতিক ধারা' সৃষ্টি করেছিল বলে মনে করেন বহু রবীন্দ্র সমালোচক৷ অনেকেরই ধারণা, এ নাটকে সমকালীন ব্রিটিশ-ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷
সে সময় (১৯২০-১৯২২) ভারতে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন, মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলন এবং শহরের শ্রমিক ধর্মঘটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক সংগ্রাম এক উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছেছিল৷ স্বাভাবিক কারণেই, এসব আন্দোলন এবং বিদ্রোহ নির্মম ও হিংস্রভাবে দমন করছিল ব্রিটিশ সরকার৷ চলছিল কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনও৷ একে একে আটক হয়েছিলেন মতিলাল ও জওহরলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশসহ কংগ্রেসের হাজারো নেতাকর্মী৷ এরপর একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চাষীরা একটি থানা পুড়িয়ে দিলে, তাঁর ‘অহিংস' আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন গান্ধী৷ মার্চে তাঁকেও গ্রেপ্তার করার হয়৷ আর তারই পটভূমিতে ‘মুক্তধারা' সৃষ্টি করেন কবিগুরু৷
যার গল্পটি হলো এরকম : উত্তরকূট হয়ে শিবতরাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মুক্তধারা নামের একটি নদী৷ যা ছিল মানুষের জীবনসম৷ সে যাই হোক, দুর্ভিক্ষের কারণে দু'বছর যাবৎ উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ-কে খাজনা দিচ্ছিল না শিবতরাইয়ের মানুষ৷ আর সেই খাজনা আদায় করতেই যুবরাজ অভিজিৎকে নিয়োগ করা হয় সেখানকার শাসনকর্তা হিসেবে৷ কিন্তু প্রজাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে অভিজিৎ বাকি খাজনা তো আদায় করলেনই না, বরং কৃষকদের জন্য খুলে দিলেন একটি গুপ্ত বাণিজ্য-পথ৷ যেই পথে স্থানীয় পশম বিদেশের বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন শিবতরাইবাসী৷ স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন রাজা৷ বন্ধ করে দেওয়া হয় মুক্তধারার গতিপথ৷ সৃষ্টি করা হয় এমন এক বাঁধ, যা শিবতরাইবাসীদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়৷ এতে অভিজিৎ-এর হাত রয়েছে মনে করে, কৃষকরাও যায় তাঁর বিরুদ্ধে৷ কিন্তু, যুবরাজ অভিজিৎ অস্ত্র নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই বাঁধ ভেঙে ফেলেন৷ মুক্তধারার তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাঁকে৷
এ নাটকে কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন কেমন হওয়া উচিত – সে সম্পর্কে একটা ইঙ্গিত থাকলেও, হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন নি কবি৷ সুনজরে দেখেন নি সন্ত্রাসবাদকে৷ এমনকি ‘দেশহিত', ‘পথ ও পাথেয়' ইত্যাদি প্রবন্ধে বিপ্লবীদের পরোক্ষভাবে ভর্তসনাও করেন তিনি৷
তাই অভিজিৎ নিপীড়িত পক্ষের হয়ে আত্মবিসর্জন দিলেও, রবীন্দ্রনাথের কাছে সে ছিল ‘মারণেওয়ালাদের' ভেতরের পীড়িত মানুষ৷ অর্থাৎ ইংরেজ পক্ষের৷ কবির নিজের কথায়, ‘‘নিজের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সে প্রাণ দিয়েছে৷'' অতএব প্রাণ দিয়েই মারণ-যন্ত্রকে ভেঙেছে অভিজিৎ, যন্ত্র দিয়ে নয়৷ আর অহিংসবাদী গান্ধীর সমান্তরালে কবি সৃষ্টি করেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগীকে৷ যেন প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে নিজেরই সর্বনাশ বয়ে এনেছে ইংরেজ-রাজ৷
অবশ্য ‘মুক্তধারা'-র মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশ সম্পর্ক প্রতীকায়িত হওয়ার বিষয়টিকেও নাকচ করা যায় না৷ এমনকি সে সময়ের পত্র-পত্রিকাতে অসহযোগ আন্দোলনকেন্দ্রিক নাটকই বলা হয়েছে ‘মুক্তধারা'-কে৷ যেখানে, অনেক অমিল সত্ত্বেও গান্ধীর অত্যন্ত কাছাকাছি এসে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ৷ বেছে নিয়েছিলেন শুদ্ধ শুচি, রুচিমন্ডিত অহিংসার পথ৷
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়