রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর
৫ জুন ২০১৩ঠিক ডাকঘরের অমলের মতো, রাজার চিঠি আসার আগেই বিদায় নিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ৷ তাঁর অকালপ্রয়াণের পরই নানা আলোচনার সূত্র ধরে প্রকাশিত হলো তথ্যটা৷ সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঋতুপর্ণ যে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন, সেই জীবনস্মৃতি-র শেষপর্বে তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে একদল ইহুদি ছেলেমেয়েকে সামিল করে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকটি অভিনয়ের প্রসঙ্গ৷ নাৎসি অধিগৃহীত পোল্যান্ডে এই ডাকঘর নাটক কীভাবে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো অনাথ শিশুদের, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মৃত্যু-মিছিলে কেমন করে জীবনের জয়পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ওই নাটক, তা দিয়েই তথ্যচিত্রটি শেষ করেছেন ঋতুপর্ণ৷
রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষে পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে যেমন একটি তথ্যচিত্র তৈরি করিয়েছিল ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার ও সংস্কৃতি মন্ত্রক, তেমন সার্ধশতবর্ষে ঋতুপর্ণ ঘোষকে একটি তথ্যচিত্র তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ দীর্ঘ প্রায় এক বছর এই তথ্যচিত্র তৈরিতে মগ্ন ছিলেন ঋতুপর্ণ৷ এই সময়ের মধ্যে অন্য কোনও কাজে তিনি হাত দেননি৷ অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়াশোনা এবং তথ্য আহরণের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় তারও অনেক আগে থেকে৷ এই গবেষণাকর্মে এতটাই নিয়োজিত এবং স্থিতধি থাকতে পেরেছিলেন ঋতুপর্ণ যে জনান্তিকে এমন গর্বিত উচ্চারণও তাঁর কাছ থেকে শোনা গেছে যে, তিনি যত গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথকে অধ্যয়ন ও অনুধাবন করেছেন, সমসময়ে দ্বিতীয় কেউ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে অতটা আত্মস্থ করতে পারেননি৷ সেই আত্মবিশ্বাসী সংলাপের চিত্ররূপ হলো জীবনস্মৃতি, যার শেষে ঋতুপর্ণ বলেছেন ওয়ারশ-র ইহুদি বস্তিতে ডাকঘর নাটকের সেই ঐতিহাসিক অভিনয়ের কথা৷
১৯৪২ সালে ওয়ারশ-র ইহুদি বস্তিতে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছিলেন ইয়ানুস করজাক নামে এক পোলিশ-ইহুদি শিশু চিকিৎসক এবং শিশু সাহিত্যিক৷ রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর তার বহু আগে থেকেই ইওরোপে পরিচিত৷ রবীন্দ্রনাথ নাটকটি লিখেছিলেন ১৯১২ সালে৷ তার পরের বছরই বিখ্যাত কবি ডাব্লিউ বি ইয়েটস এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন৷ লন্ডনের আইরিশ থিয়েটারে নাটকটি অভিনীত হয়৷ সেই প্রথম সন্ধ্যায় দর্শকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন৷ এরপর একাধিক ইওরোপীয় ভাষায় অনুদীত হয় ডাকঘর, অভিনয়ও হয়৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, যখন নাৎসি আগ্রাসন এবং সন্ত্রাস সারা ইওরোপে, তখন রবীন্দ্রনাথের এই নাটকটি প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র হয়ে ওঠে৷ মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি আর জীবনকে ভালবাসার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে ডাকঘরের অমল৷ খাস জার্মানিতে শতাধিকবার অভিনীত হয় ডাকঘরের জার্মান রূপান্তর৷ ফরাসি ভাষায় এটি অনুবাদ করেন অঁদ্রে জিদ৷ শোনা যায়, যে রাতে প্যারিসের পতন ঘটছে, নাৎসি দখলে চলে যাচ্ছে ফ্রান্স, সেই রাতে ফরাসি বেতারে পড়ে শোনানো হয়েছিল জিদ-এর করা ডাকঘরের সেই ফরাসি অনুবাদ৷ এমনকি নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও মৃত্যুভয়কে জয় করে জীবনের জয়গান গাইতে বার বার অভিনীত হয়েছে ডাকঘর৷
শিশু সাহিত্যিক ও চিকিৎসক ইয়ানুস করজাক ছিলেন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ-তে একটি অনাথ আশ্রমের পরিচালক৷ দখলদার নাৎসিরা তখন পোল্যান্ডেরও তথাকথিত শুদ্ধিকরণের কর্মসূচি নিয়েছে৷ সেদেশে বসবাসকারী ইহুদিদের চিহ্নিত করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কুখ্যাত ত্রেবলিঙ্কা এক্সটারমিনেশন ক্যাম্প অর্থাৎ নিধন শিবিরে৷ ওয়ারশ-র ইহুদি বস্তির ওই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদেরও তখন গণ নিধনের জন্য ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ ডাঃ করজাক যদিও সুযোগ পেয়েছিলেন চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে নিজের প্রাণ বাঁচানোর৷ কিন্তু তিনি ঠিক করেন, অনাথ বাচ্চাদের সঙ্গেই থাকবেন৷ এবং আক্ষরিক অর্থেই আমৃত্যু ওই শিশুদের সঙ্গে ছিলেন ডাঃ করজাক৷ ত্রেবলিঙ্কা নিধন শিবিরে, নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে পাছে তাঁর বাচ্চারা ভয় পায়, রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের পোলিশ ভাষান্তর ওদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন করজাক, নিজে অভিনয় করেছিলেন রাজবৈদ্যের ভূমিকায়৷
এই ইতিহাস জানার পর, রবীন্দ্রনাথের দেশের মানুষ হিসেবে, তিনি যে ভাষায় লিখে গিয়েছেন, সেই বাংলা ভাষার মানুষ হিসেবে যেমন গর্বিত হতে হয়, তেমনই গর্বিত হতে হয় তাঁর এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে৷ মানব সভ্যতার চরম বিপর্যয়ের সময়ও রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব মানবাত্মার বিবেক হয়ে থেকেছেন, এটা জানার পর শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়৷ আর কোথাও একটু প্রত্যয়ও হয় যে, সত্যিই, ঋতুপর্ণর চোখ দিয়ে আমরা এমন এক রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করব, যাঁর দেখা এর আগে আমরা কেউ পাইনি৷