যৌনপল্লি বদলাচ্ছে, সমাজ নয়
২৩ জানুয়ারি ২০১৭কলকাতার সোনাগাছি৷ ভারতীয় উপমহাদেশের সবথেকে পুরনো, সবচেয়ে বড় যৌনপল্লিগুলির মধ্যে অন্যতম৷ আজ থেকে ২৫/-৩০ বছর আগেও এই সোনাগাছি ছিল সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত যৌনকর্মীদের এলাকা, যেখানে চলতো গুন্ডা, মাস্তান আর পুলিশের দাপট৷ যৌনরোগের সংক্রমণ ছিল ব্যাপক৷ যৌনকর্মীদের আর্থিক সুরক্ষা বলে কিছু ছিল না৷ তাঁদের সন্তানদেরও ছিল না কোনো ভবিষ্যৎ৷ যৌনকর্মীর কন্যাসন্তান ফের একজন যৌনকর্মীই হবে, এটাই ছিল একমাত্র নিশ্চয়তা৷
সেসময় বহু মেয়েকে ফুসলিয়ে বা জোর করে ধরে নিয়ে এসে, তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনপেশায় নামিয়ে দেওয়া হতো৷ এরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই হতো গরিব পরিবারের সন্তান, অনেকেই নাবালিকা৷ তারা না চাইলেও যৌনবৃত্তিতে বাধ্য হতো৷ পুলিশ বা প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়াত না৷ উল্টে হেনস্থা বাড়ত৷ রাজনৈতিক দলগুলোও ভোট চাওয়ার বাইরে এই এলাকায় পা রাখত না. তবে পৌঁছে গিয়েছিল মারাত্মক রোগ ‘এইডস'৷ যৌনকর্মীদের থেকে যে রোগ ছড়িয়ে পড়ত বৃহত্তর সমাজে৷
কিন্তু এ সব এখন ইতিহাস৷ ১৯৯০-এর দশকেই পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল৷ আর এখন আমূল বদলে গেছে সোনাগাছি৷ এক কথায় বলতে গেলে, এখানকার মেয়েদের এক বিপুল ক্ষমতায়ন হয়েছে গত আড়াই দশকে, যার শুরু হয়েছিল আদতে এইডস সংক্রমণ রোখার লড়াই এবং নারী পাচার বন্ধের উদ্যোগের হাত ধরে৷ জন্ম নিয়েছিল যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংগঠন ‘দূর্বার মহিলা সমিতি', যা এখন দূর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি৷ সামাজিকভাবে প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি কাজটা করেছিল দূর্বার, তা হলো সোনাগাছির যৌনকর্মীদের জন্যে একটা মঞ্চ গড়ে দেওয়া, যার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেদের কথা বলতে পারেন৷ মাথার ওপর একটা ছাতা হয়ে দাঁড়ানো, আপদে-বিপদে যে ছাতার তলায় তাঁরা আশ্রয় নিতে পারেন৷ এবং শুধু যৌনকর্মীরাই নন, তাঁদের ‘খদ্দেররা', চলতি ভাষায় যাঁদের ‘বাবু' বলা হয়, তাঁদেরকেও সংগঠিত করেছে দূর্বার৷ এই বাবুদের জন্যে তৈরি হয়েছে ‘সাথী' সংগঠন, যার ‘সহায়তা কিয়স্ক' চালু হয়েছে সোনাগাছি ও শহরের অন্য যৌনপল্লিতে, যেখানে তাঁরা দরকার হলেই গিয়ে সাহায্য চাইতে পারেন৷ সাধারণভাবে যাঁরা নিয়মিত যৌনপল্লিতে যাতায়াত করেন, তাঁরা সামাজিকভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যেহেতু সমাজ তাঁদের সুনজরে দেখে না৷ সেই মানসিকতা থেকে তাঁদের মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে এবং একই সঙ্গে এইডস ও অন্যান্য যৌন রোগ সম্পর্কে এক বৃহত্তর সচেতনতার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে৷ পরিণতিতে সব ধরনের যৌন রোগের প্রকোপ আজ অনেক কমে গেছে সোনাগাছিতে৷
একই ঘটনা ঘটেছে যৌনকর্মীদের সন্তানদের ক্ষেত্রে৷ তাদের পড়াশোনা শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা অন্য পেশায় যেতে পারে, স্বাবলম্বী হয়৷ যৌনকর্মীর সন্তানেরা যাতে কোনোভাবে সমাজে নিজেদের অচ্ছ্যুৎ বা অপাংক্তেয় না মনে করতে পারে, সেজন্য খুব জরুরি ছিল এই উদ্যোগ৷ এখন যৌনকর্মীর সন্তানেরাও মূল ধারার স্কুলে ভর্তি হচ্ছে৷ তাদের নিজস্ব একটা ফুটবল দল হয়েছে, যে দল গত বছর তৃতীয় ডিভিশনে খেলার পর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার যোগ্যতামান পার করেছে৷ এর মধ্যে একবার ইউরোপে খেলে এসেছে এই ফুটবল দল৷ এছাড়া মাঝেমধ্যেই নানা ধরনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প, কর্মসূচির শরিক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এরা৷ কয়েক বছর আগেই যেমন জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর একটি প্রকল্পে এদের হাতে ক্যামেরা তুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ছবির ভাষায় এরা নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে৷
তা হলে পুরো ছবিটাই কি প্রগতির এবং খুব আশাজনক? না, বলছেন ডা. স্মরজিৎ জানা, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন দূর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে৷ কিছু সাফল্য অবশ্যই এসেছে৷ যেমন সোনাগাছির যৌনকর্মীদের যে সমবায় তহবিল, সেই ‘ঊষা কোঅপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড'-এর নিবন্ধিকরণ করা গেছে যৌনকর্মীদের নামেই৷ এটা একটা বিরাট বড় সাফল্য, যেহেতু যৌন পেশা এখনও বৈধ বৃত্তি বলে স্বীকৃত নয় ভারতের আইনে৷ কিন্তু ঐ মূল জায়গাটায় সমস্যা থেকে গেছে৷ বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও যৌনবৃত্তিকে বৈধ পেশার স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি৷ এ নিয়ে আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই৷ যেমন যৌনকর্মীর সন্তানদের জন্য বারুইপুরে একটি হস্টেল চালু হয়েছে, যেখানে থেকে সাধারণ স্কুলে, আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে তারা৷ আলাদা পরিবেশে থেকে৷ কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী তো এখনও বদলায়নি৷ ফলে কোনো শিক্ষকই হয়ত ঘুরিয়ে এমন কোনো একটা খোঁচা দিয়ে দিলেন যে, বাচ্চাটির খারাপ লাগল৷ যে কারণে স্কুল থেকে ‘ড্রপ আউট'-এর সংখ্যাও খুব বেশি, জানালেন ডা. জানা৷
তবু চেষ্টা চলছে, লড়াই চলছে, চলবেও৷ সোনাগাছি এবং কলকাতার খিদিরপুর, কাশীপুর, বউবাজার অঞ্চলের যৌনপল্লির মেয়েরা এখন অন্তত এটা জানেন যে তাঁরা আর একা নন৷ নিজেদের অধিকারের লড়াইটা তাঁরা নিজেরাই লড়ছেন, তবে একসঙ্গে৷
বন্ধ, কেমন লাগলো প্রতিবেদনটি? লিখুন আপনার মন্তব্য, নীচের ঘরে৷