যেন সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর কলকাতা!
৬ নভেম্বর ২০১৪চলতি সপ্তাহের বুধবার থেকে শুক্রবার, টানা তিন দিন কলকাতার খিদিরপুর ডক ইয়ার্ডে নোঙর ফেলে থাকার কথা ছিল ভারতীয় নৌ-বাহিনীর দুই রণতরী আইএনএস কুকরি এবং আইএনএস সুমিত্রার৷ এই তিনদিনে শহরের সাধারণ মানুষ ওই দুটি রণতরী ঘুরে দেখতে পারবেন, নৌ-সেনাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের কৌতূহল মেটাতে পারবেন, এমনই পরিকল্পনা ছিল৷
কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য নৌ-বন্দরে এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়৷ জনসংযোগ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে বহু বছর ধরেই ভারতীয় নৌ-বাহিনী এ ধরনের প্রদর্শনী করে থাকে৷ বহু মানুষ, বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা উৎসাহ নিয়ে যুদ্ধজাহাজগুলি ঘুরে দেখে৷ কিন্তু এবার নতুন যেটা ঘটল, নোঙর ফেলার পরদিনই রণতরীদুটি তড়িঘড়ি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সমুদ্রের দিকে৷
কারণ, ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর ছিল, এই প্রদর্শনীতে জনসমাগমের সুযোগ নিয়ে নাশকতার ছক কষেছে পাকিস্তানি জঙ্গিরা! ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে যদিও বলা হয়েছে, কৌশলগত কারণেই রণতরী দুটি সমুদ্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো৷ কিন্তু এটাও ঘটনা যে অতীতে এ রকমভাবে প্রদর্শনী বাতিল করে কৌশলগত সক্রিয়তা দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি কখনও!
সেখানেই প্রশ্ন উঠছে, যে হঠাৎ কী এমন ঘটল যে উত্তরপূর্ব ভারতের এই আপাত শান্ত শহর তথা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি সন্ত্রাস-মানচিত্রে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল! কারণ কলকাতা শহরে বড় নাশকতার ঘটনা বলতে এক যুগ আগে অ্যামেরিকান কালচারাল সেন্টারে জঙ্গি হামলা৷ তাছাড়া, সম্প্রতি খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ এবং তার সূত্র ধরে রাজ্যের কয়েকটি জেলায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ব্যাপকতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গকে জঙ্গিদের ‘সেফ প্যাসেজ' হিসেবেই দেখা হয়েছে৷
কিন্তু এখন হঠাৎ কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গই কেন এত গুরুত্ব পাচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিকর তথ্য সামনে এসে পড়ছে৷ যা ইঙ্গিত করছে, এই রাজ্য কোনোদিনই স্রেফ নিরাপদ যাতায়াতের পথ হয়ে থাকেনি, বরং ভারতে একাধিক নাশকতার ছক কষা হয়েছে এখানকার মাটিতে, বিস্ফোরকের জোগান গেছে এই রাজ্য থেকেই৷ সর্বশেষ খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের সূত্রে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য থেকে তো এমনও সন্দেহ করা হচ্ছে যে প্রতিবেশী বাংলাদেশে মারাত্মক নাশকতার রসদ তৈরি হচ্ছিল এখানেই৷
ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ-র প্রধান সম্প্রতি বর্ধমানে তদন্তে এসে একটা প্রশ্ন বার বার করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে সন্ত্রাসিদের ঘাঁটি না হয়ে বর্ধমানেই কেন একাধিক ডেরা বেঁধেছিল তারা! যদি গোপনে বিস্ফোরক বানিয়ে পাচার করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে সীমান্তের জেলাগুলিই তো সুবিধাজনক হতো সন্ত্রাসিদের পক্ষে৷
রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা এই প্রশ্নের যেসব জবাব দিয়েছেন, তাতে খুশি হতে পারেননি এনআইএ প্রধান৷ তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গ নিরাপদ, এই একটি ভ্রান্ত ধারণা সম্ভবত রাজ্য পুলিশকেও নিশ্চিন্তে রেখেছিল যে, এখানে তাদের করার বিশেষ কিছু নেই৷ যার ফলে নিয়মিত নজরদারি বা খবর রাখা, সন্দেহজনক এলাকা চিহ্নিত করা, সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি রাখা, এসবে যথেষ্ট তৎপরতা তাদের ছিল না৷
কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এনআইএ প্রধান বার বার একই খটকার কথা তুলে কার্যত বলে গেলেন, তার মানে বর্ধমানের মতো জেলায় এবং সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের আরও কিছু জেলায় সন্ত্রাসি নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত এবং সক্ষম, সক্রিয় যে, সন্ত্রাসিরা আত্মবিশ্বাসী ছিল নির্বিবাদে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে৷ আর আরও মারাত্মক ইঙ্গিত হলো, এক-দু'দিনে এই ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায় না, এটা অনেকদিন ধরেই রয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর তথাকথিত ‘স্লিপার সেল' এক বা একাধিক রয়েছে, এ ইঙ্গিতও দিয়ে গিয়েছেন এনআইএ গোয়েন্দারা৷ যার ফলে এখন আল-কায়েদা জঙ্গিরাও আতঙ্ক হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখছে কলকাতা বন্দরে!