যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি কতটা ঘনিষ্ঠ?
২৯ অক্টোবর ২০২৪সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানির সম্পর্ক মধুর ছিল না৷ এরপর ২০২১ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধন, নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতে সবকিছুই পুনস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যায় দেশ দুটি৷ তবে সবসময় যে সম্পর্ক খুব মসৃণ ছিল তা বলা যাবে না৷
রাশিয়া থেকে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য স্থাপিত নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইনের বিষয়ে নেতিবাচক ছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ শুধু তাই নয়, ৫জি নেটওয়ার্ক থেকে চীনের হুয়াই এবং জেডটিইকে বাদ দিতে জার্মানিকে চাপ প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ বন্ধু দেশের সঙ্গে এমন আচরণ অস্বাভাবিক এবং দৃষ্টিকটু৷
এর মাঝে ঘটলো আরেক ঘটনা৷ ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র৷ মার্কিন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য বিস্ময়কর ছিল৷
তার আগে দীর্ঘ ১৬ বছর দেশ পরিচালনার পর অবসর গ্রহণ করেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তার অবসর খুব একটা বিস্ময়কর না হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন চোখে পড়েছে৷ ম্যার্কেলের পর দায়িত্বে আসা চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন৷ এসকল সাক্ষাতে প্রতিবারই তিনি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর গুরত্বারোপ করেছেন৷
অক্টোবরে জার্মানি সফর করেন জো বাইডেন৷ এ সফরে গ্র্যান্ড ক্রস অফ দ্য অর্ডার অফ মেরিট সম্মাননা প্রদান করা হয় তাকে৷ জার্মান সরকারের কাছ থেকে এই সম্মাননা পাওয়া দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন৷
সামরিক শক্তি এবং সমন্বিত চেষ্টা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের একটি অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউরোপের নিষ্প্রভ অথনৈতিক অবদান৷ অবশ্য ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর নিজেদের সামরিক শক্তি এবং নিরাপত্তা নীতির বিষয়ে পুনরায় ভাবতে শুরু করে জার্মানি৷
রাশিয়ার হামলার কয়েকদিন পর জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে যুগান্তকারী বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা ছিল সামরিক খাতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকা জার্মানির কৌশলের ঠিক বিপরীত৷ সেই সময় সামরিক খাতে একশ বিলিয়ন ইউরোর একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেন শলৎস৷
তাছাড়া রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞার সমর্থন দিয়েছে জার্মানি৷ সম্প্রতি হওয়া বন্দি বিনিময়ের বিষয়টিতে একসাথে কাজ করেছে দেশ দুটি৷ গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরতা থেকেও বেরিয়ে এসেছে জার্মানি৷ ঘাটতি পূরণের জন্য এলএনজি আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে দেশটি৷
সামরিক শক্তি এবং দূর পাল্লার মিসাইল
গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দিতে গিয়ে একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছে জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র৷ দু'দেশই গাজায় দীর্ঘ মেয়াদে একটি যুদ্ধ বিরতির জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়েছে৷
তবে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিমতের জায়গা হতে পারে জার্মানিতে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি৷ জার্মানিতে বর্তমানে ৩৫ হাজার মার্কিন সেনা দায়িত্বরত রয়েছে৷ ইউরোপীয়দের অনেকেই অবশ্য এমন উপস্থিতির মাধ্যমে নিরাপত্তার বিষয়টি উপভোগ করেন৷
এদিকে ২০২৬ সালে জার্মানিতে দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র৷ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হলে সেটি হবে ১৯৯০ সালের পর হওয়া এমন কোনো ঘটনা৷ বলা হচ্ছে, এই অস্ত্র শুধু জার্মানিকে সুরক্ষা দেবে- বিষয়টি এমন নয়, বরং, ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় সদস্য পোল্যান্ড এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর সুরক্ষায় তা কাজে দেবে৷
তবে জার্মানির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি দেশটির সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই সম্পাদিত হয়েছে৷ দেশটির বাম ও ডান দল, এমনকি ক্ষমতায় থাকা শলৎসের নেতৃত্বাধীন জোটের ভেতর থেকেও এই চুক্তির সমালোচনা রয়েছে৷
অর্থনীতিই বড় বিষয়!
দুই দেশকে এক বন্ধনে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো অর্থনীতি৷ জার্মানির বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হলো যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটিতে জার্মানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগদাতা হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে৷ ওয়াশিংটনে জার্মান দূতাবাসের তথ্য বলছে, জার্মানির প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে নয় লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে৷
২০২৩ সালের শেষ দিকে ক্যোরবের ফাউন্ডেশন এবং পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণা বলছে, ৮৫ ভাগ অ্যামেরিকান এবং ৭৭ ভাগ জার্মান মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্ক ভালো অবস্থানে রয়েছে৷ ওই গবেষণায় আরো দেখা যায়, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দুই দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন বেশিরভাগ জার্মান এবং অ্যামেরিকান৷ অ্যামেরিকার প্রতি ১০ জনে সাত জন চীনকে অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি মনে করেন৷ বিপরীতে প্রতি দশজনে পাঁচ জন জার্মান চীনকে অর্থনীতির জন্য হুমকি বলে মনে করেন৷
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফাইভ-জি নেওয়ার্ক থেকে চীনা কোম্পানিগুলোকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন ও অনুসরণ করেছে জার্মানি৷ তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো চিপ উৎপাদন কারখানাও তৈরি করছে জার্মানি৷ এর উদ্দেশ্যে হলো, চিপের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভরতা কমানো৷ বিশেষ করে তাইওয়ানের উপর নির্ভরতা কমানো, এটি বিবেচনায় নিয়ে যদি চীন তাইওয়ান আক্রমণ করে৷
ট্রাম্প বা কমলা: নতুন দিনের সম্পর্ক
সামনের দিনগুলোতে জার্মানি এবং ইউরোপের যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না৷ আর কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক এমনটাই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তবে জার্মান সরকার হয়তো একটি বিশেষ পরিকল্পনা হাতে রাখছে৷
আসছে নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্টের সমর্থন এবং ইউরোপে অ্যামেরিকান সৈন্যের বিষয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং ইউরোপকে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দী হিসেবে দেখেন৷ এর মানে দাঁড়াতে পারে- কম সহযোগিতা, অধিক ট্যারিফ কিংবা বাণিজ্য-যুদ্ধ৷
নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় নিয়ে গবেষকদের অনেকে এমনটাই পর্যালোচনা করছেন৷ জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র রিসার্চার রাচেল টাউজেন্ডফ্রয়েন্ড বলেন, দ্বিতিয়বারে মতো ট্রাম্পের বিজয় ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্কে আরো বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷
গবেষণাপত্রে তিনি আরো বলেন, জার্মানির উচিত নিরাপত্তা এবং বিশ্ব কৌশলের ক্ষেত্রে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থিত করা- নির্বাচনে যে-ই জিতুক না কেন৷
সবকিছু ঠিকঠাক মতো চালিয়ে যেতে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিষয়ের সাথেই একমত হয়েছে জার্মানি৷ এই কৌশল দুইপক্ষের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছিল এবং হয়ত এর খুব একটা পরিবর্তন হবে না৷ খুব দৃঢ় বন্ধুত্বও কখনো কখনো সমানে সমান হয় না৷
প্রতিবেদন: টিমোথি রুকস/আরআর