যখন কর্মক্ষেত্রে নারীরাও ‘পুরুষ’
৫ মার্চ ২০১৯‘নারীর অধিকার’ শব্দগুচ্ছটি ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’র মতোই একটি বিতর্কিত বিষয়৷
ঠিক কোন জায়গায় নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শেষ হয়, আর কখন সেটা অন্যের ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আঘাত হানে, সে নিয়ে তর্ক দীর্ঘদিনের৷ ঠিক তেমনই, নারীর অধিকার বলতে আসলে নারীকে বেশি সুযোগ দেয়া কি না, এতে সবার সমান যোগ্যতা কখনও বাধাগ্রস্ত হয় কি না, সে নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই৷
কিন্তু আজ আর অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাই না৷ বলতে চাই, তারচেয়েও বেশি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের আধিপত্য কমাতে গিয়ে কখনও কখনও নারীদের সুযোগ দেয়া হয়, আর তাঁরাই তখন নিজেরাই সে পুরুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন৷
এ প্রসঙ্গে কয়েকটা ঘটনার কথা বলতে চাই৷
ঘটনা-১: একটি বেসরকারি গণমাধ্যম৷ নারীর অধিকার নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার গণমাধ্যমের কর্তৃপক্ষ৷ সামান্য হয়রানির ঘটনাকেও অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়৷ কিন্তু গণমাধ্যমটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত পার্টিতে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ বস পুরুষ কর্মীদের কাজ বাড়িয়ে দিয়ে হলেও নারী কর্মীদের সেখানে উপস্থিত থাকার আদেশ দেন৷
আপাতদৃষ্টিতে এই আদেশ নারীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার উদাহরণ মনে হলেও, এর আসল কারণ পার্টিতে আগত বিশেষ বিশেষ অতিথিদের সামনে গ্ল্যামার উপস্থাপন করা৷ নারী সহকর্মীরাও বেশ সম্মানবোধের সাথে সেখানে হাজির হন৷ কিন্তু আসলেই কি সেখানে নারী হিসেবে তাঁদের সম্মানিত করা হয়?
ঘটনা-২: নারায়ণগঞ্জে সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার হোসেন আরা বেগমকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ওএসডি করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল কিছুদিন আগে৷ এমনকি এ নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়, ক্ষোভ জানান সংসদ সদস্যরা৷
কিন্তু এমন অনেককিছুই আসে না আলোচনায়৷ আরেকটি বেসরকারি অর্থনৈতিক সংস্থার কয়েকজন নারী কর্মী কাছাকাছি সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন৷ ঘটনাচক্রে সংস্থাটির প্রধানও একজন নারী৷ ফলে সে অফিসে নারীদের একটু বেশিই নিরাপদ বোধ করার কথা৷ কিন্তু মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে গেলে নারী প্রধানের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘এখন ছুটি চাইতে এসেছেন কেন? আমাকে বলে কি সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন?’’
ঘটনা-৩: একটি গবেষণা সংস্থা৷ এক তরুণী কর্মী দীর্ঘদিন ধরে বেশ দক্ষতার সঙ্গে নিজের দায়িত্বে পালন করছেন৷ কিন্তু অনেকদিন ধরে তার পদোন্নতি বা বেতনবৃদ্ধির কোনো খবর নেই৷ এ নিয়ে তার বেশ কিছুদিন ধরে ক্ষোভও ছিলো৷ তা জানতে পেরে, একদিন বস সে কর্মীকে ডাকলেন নিজের রুমে৷ কাঁচুমাচু করে ঢোকার পর যা ঘটলো, তাতে সে কর্মী স্তব্ধ হয়ে গেলেন৷ সে বস পদোন্নতির বিনিময়ে সরাসরি তরুণীকে ডাকলেন নিজের বিছানায়৷ রাগে-ক্ষোভে সেখান থেকে বের হয়ে বসের সেকেন্ড ইন কমান্ড অর্থাৎ, দ্বিতীয় বসের কাছে গেলেন তরুণী৷ দ্বিতীয় বস নারী হওয়ায় সব কথা শেয়ার করতে কোনো দ্বিধা করতে হয়নি তরুণীকে৷ এবার আরো অবাক হওয়ার পালা৷ নারী বস বলে বসলেন, ‘‘কাজে উন্নতি করতে গেলে শুধু মাথা থাকলে হয় না৷ সবকিছুই কাজে লাগাতে হয়৷’’
এমন কিছু ঘটনা কাছের মানুষের সাথে ঘটায় আমি জানতে পেরেছি৷ কিন্তু এমন অধিকাংশ ঘটনা সাধারণত কারো সাথে শেয়ারই করতে পারেন না নারীরা৷ সেই একই কর্মক্ষেত্রে সব অপমান সহ্য করে সেই মানুষদের সাথেই তাঁদের কাজ করে যেতে হয়৷
কখনও কখনও পরিবার বা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলেও, ‘চেপে থাক, লোকে কি বলবে’ শুনে দমে যেতে হয়৷
এখনও মনে আছে, হেফাজতে ইসলামীর কর্মীদের হাতে নারী সাংবাদিক নাদিয়া যখন লাঞ্ছিত হলেন, প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছিল, এমন একটি জায়গায় কেনো একজন নারী সাংবাদিককে পাঠানো হয়েছিল৷ আর সে প্রশ্ন সমান স্বরে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল নারীকণ্ঠেও৷ কেনো কোথাও সাংবাদিক পাঠাতে হলে, নারী না পুরুষ বিবেচনা করতে হবে, সে প্রশ্নটি আর উচ্চারিত হয়নি কোথাও৷
এক সাবেক সহকর্মীকে চিনি, অফিসে যার প্রধান বিনোদন নারী সহকর্মীদের নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলা৷ আমার খুব অস্বস্তি হলেও, তার আশেপাশের অন্য সহকর্মীরা তার এই ‘চটুল’ কথাবার্তায় বেশ আনন্দই পান, অথবা আনন্দ পাওয়ার অভিব্যক্তি দেখান৷
মাঝে মাঝে কোনো কনিষ্ঠ নারী সহকর্মী সেটাতে আপত্তি জানালে অন্য নারী সহকর্মীরাই তীব্র প্রতিবাদ জানান, ‘‘আরে, উনি কি কিছু মিন করেছে? উনি তো এমনিই মজা করে বলে৷’’
এমন আরো হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে, যেখানে নারীদের নিরাপত্তায় পুরুষদের বুঝে না বুঝে সহযোগী হচ্ছেন নারীরাই৷ ‘দয়া’ বা ‘দান’ হিসেবে পুরুষের সমকক্ষ না হয়ে, বা পুরুষ হওয়ার চেষ্টা না করে নারীরা যতোদিন নারী না হচ্ছেন, ততোদিন কর্মক্ষেত্রে সাম্যাবস্থা মোটেও আসবে না৷
লেখকের মতো আপনার চোখেও কি কোনো ঘটনা ধরা পড়েছে? লিখুন নীচের ঘরে৷