মৌলবাদীদের চরিত্র বদলায় না, বংশপরম্পরায় একই থাকে: সুবর্ণা
৮ এপ্রিল ২০২২টিপ পরা নিয়ে একজন শিক্ষিকাকে পুলিশ সদস্যের করা কটূক্তির বিষয়টি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷ এই ঘটনায় নতুন করে আলোচনা হচ্ছে এটা কি শুধু একজন পুলিশ সদস্যের মন্তব্য নাকি আমাদের সমাজের চিত্র? আমাদের সমাজে কি ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা তুলেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা এমপি৷ সেই প্রেক্ষাপটে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এই সংসদ সদস্য৷
ডয়চে ভেলে : টিপ পরা একজন নারীর স্বাধীনতা৷ বাংলাদেশের নারীরা কি এই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন না?
সুর্বণা মুস্তাফা : বাংলাদেশের নারীরা এই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন৷ পারছেন না এটা বলা যাবে না৷ পহেলা বৈশাখ, ঈদ, দূর্গাপূজা, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে তো আমরা টিপ পরতে দেখছি৷ টিপ তো এখানে সিম্বলের মতো হয়ে গেছে৷ টিপ পরার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে৷ আমি তো সংসদেও বলেছি, টিপ পরা যাবে না, এমন আইনকানুন তো কোথাও নেই৷ যুগ যুগ ধরে নারীরা তো টিপ পরে আসছেন৷ আমি মনে করি, এই ঘটনাটি ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর বিরাট হস্তক্ষেপ৷
সাম্প্রতিক ঘটনাটি কি শুধু একজন পুলিশ সদস্যের মন্তব্য নাকি আমাদের সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে?
এটা সমাজের চিত্র এমন করে কি বলা যাবে? যে ব্যক্তি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি পোশাক পরা ব্যক্তি৷ এটা যদি একজন সাধারণ মানুষ করতেন, যিনি বিশেষ পোশাক পরা না তখন আমি সমাজ নিয়ে কথা বলতে পারতাম৷ যখন বিশেষ পোশাক পরা থাকে তখন তাদের শ্রেণী আলাদা হয়ে যায়৷ দায়িত্বে জায়গা আলাদা হয়ে যায়৷ সবকিছু এই ব্যক্তি লঙ্ঘন করেছেন৷ আমি আসলে এটা জেনারেলাইজ করতে চাই না৷ আমাদের সমাজে বা পুরো পৃথিবীর চেহারাটাই হলো পুরুষশাসিত সমাজ৷ এখানে মেয়েদের আজ্ঞাবহ থাকতে হয়৷ মেয়েরা কিন্তু আজ্ঞাবহ থাকছে না৷ যেমন লতার কথাই ধরা যাক৷ লতা কিন্তু চুপ থাকেনি৷ লতা দ্রুত থানায় গেছেন৷ উনি তো চুপ করেও থাকতে পারতেন৷
উনি তো একজন শিক্ষক৷ কিন্তু সাধারণ নারীরা কি এভাবে এগিয়ে আসছেন?
আমি এটাকে যেভাবে দেখি, আমাদের গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির অধিকাংশ কর্মী কিন্তু নারী৷ এটা দিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছি৷ খুব বেশি দিন লাগবে না, দেখবেন প্রশাসনের বড় একটা অংশ হবে নারী৷ আর্মিতে যখন একজন নারী কমান্ডার থাকেন, প্লাটুন নিয়ে তিনি যখন সামনে যান তার পিছনে যারা হাঁটছেন তারা কিন্তু পুরুষ৷ এই জায়গায় আমাদের শিক্ষা বাড়াতে হবে৷ আমি এখানে কোনো ধর্মীয় বৈষম্য আনতে চাই না৷ আমাদের প্রচুর মুসলিম মেয়ে টিপ পরে৷ এটা যে কারও সঙ্গেই হতে পারত৷ এটা মানসিকতার ব্যাপার৷ এগুলো নিয়ে যে নেতিবাচক কমেন্ট হচ্ছে, সেটা যে করছেন এটা তার অধিকার৷ কিন্তু এগুলো সুরুচিকর হলে ভালো হতো৷ একটা কমেন্টের ভিতরেও যদি এমন বলা হতো, এটা নিয়ে উনার কথা বলার দরকার কি? এটা তো সরকার দেখছে৷ এমন করেও যদি কেউ বলত? একজনও এমনভাবে বলেনি৷
মনে কি হচ্ছে সমাজে ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে?
মৌলবাদীরা সব সময় ছিল৷ আমাদের মনে হয় সহনশীলতা বেড়ে গেছে৷ আমরা একটু সহ্য করছি বেশি আসলে৷ কিন্তু আমি যদি আমার ছোট বেলার কথা বলি, শুধু ঢাকেশ্বরী মন্দিরে একটাই পূজামণ্ডপ ছিল৷ ওখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাই যেতেন৷ এখনকার পরিস্থিতি কিন্তু আলাদা৷ এখন বনানী থেকে খামারবাড়ি হয়ে প্রচুর জায়গায় পূজামণ্ডপ হচ্ছে৷ এখানে ছেলে-মেয়ে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই সেখানে যাচ্ছে এবং আনন্দ করছে৷ যারা মৌলবাদী, তাদের তো চরিত্র বদলায় না৷ তারা বংশপরম্পরায় মৌলবাদী থাকে৷ আমরা যারা সুশীল সমাজ বা এমন কিছু বলে থাকি, আমরা কি লতার মতো প্রতিবাদ করছি কম? আমি কিন্তু এটাও জানি, পহেলা বৈশাখে আমরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি সেখানে যদি আঘাত আসে সেটা সহ্য করবে না কেউ৷ বিএনপির সময় যখন ছায়ানটে বোমা বিস্ফোরণ হল তখন অনেকেই মনে করেছিল, এখানে আর কেউ আসবে না৷ এটা বন্ধ হয়ে যাবে৷ কিন্তু আমরা কী দেখলাম? ঢাকা শহরের মানুষ প্রতিবাদ জানাতে ছায়ানটেই ছুটে আসল৷ এটাই বাঙালি চরিত্রের ইতিবাচক দিক৷
টিপ পরা ইস্যুতে সংসদে আপনার বক্তব্য ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ৷ সেখানে আপনি এমপিদের মধ্যে এটির পক্ষে বিপক্ষে কোনো অবস্থান লক্ষ্য করেছেন?
না, আমি সেটা দেখিনি৷ আমি কিন্তু সংসদে নতুন কোন তথ্য দেয়নি৷ ওইদিন সবগুলো গণমাধ্যমে এটা কিন্তু এসেছে৷ আমি এটা উত্থাপন করেছি, কারণ আমি এটা উত্থাপন করতে চেয়েছি৷ এটাই আমার প্ল্যাটফর্ম৷ আমি ফেসবুক বিপ্লবে বিশ্বাস করি না৷ আমার মনে হয়েছে, সংসদে এটা বললে অনেক বেশি মানুষের কাছে এটা পৌঁছাবে৷ আমি পুলিশ ফোর্সকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেবো৷ অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে ওই ব্যক্তি চিহ্নিত হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ আমি মনে করি না যে, আমি যুগান্তকারী কিছু একটা করেছি৷ আমি না বললে হয়ত কয়েকদিন পরে অন্য কেউ বলত৷ আমার মনে হয়েছে এটা বলা দরকার৷
সংসদে দেওয়া এই বক্তব্য দেওয়ার কারণে আপনি কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছেন কি?
আমি এটা কেয়ার করি না৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা গ্রুপ তো আছে৷ এটা তো থাকবেই৷ একটা ইংরেজি কবিতা আছে, সেটার সারাংশটা এমন, তুমি যদি বল তোমার সারা জীবনে কোনদিন বাধার সম্মুখীন হওনি, তাহলে বুঝতে হবে তুমি কখনই কোনো অন্যায়কে ঠিক করোনি৷ তুমি কোনো ভুলকে ভুল বলোনি৷ তুমি সবসময় নিরাপদ একটা জায়গায় থেকেছ৷ এর যেমন ইতিবাচক দিক আছে, আবার যারা মৌলবাদী তাদের তো পছন্দ হয়নি৷ ফলে এটা নিয়ে তো তারা কথা বলবেই৷ আমি এগুলো পড়িও না, কেয়ারও করি না৷
এখন অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও ধর্মীয় গোঁড়ামি লক্ষ্য করা যায়? আমাদের সমাজটা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে? সমাজে এর প্রভাবই বা কতটা?
এ ব্যাপারে আমার কথা খুবই স্পষ্ট৷ আমি মুসলিম, আমি ইসলামিক রুলস ফলো করতে চাইলে আমি বাঙালি মুসলমান হতে চাইবো৷ আমি সৌদি আরবের মুসলমান হতে চাই না৷ আমি মা, খালা, দাদিকে দেখেছি মাথায় কাপড় দিতে, এখনো দেন৷ আমাদের প্রধানমন্ত্রীও দেন৷ ফলে এগুলো আমি পরোয়া করি না৷ আমি বাঙালি মুসলমান হবো৷ আমার সংস্কৃতি যেটা, জাতীয়তাবোধ যেটা সেখান থেকে আমি আমার ধর্মচর্চা করব৷
টিপ পরা তো ব্যক্তি স্বাধীনতা৷ যারা এমন ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কি প্রশাসন সঠিক পদক্ষেপ করছে?
কোনো একটা ঘটনা যখন ঘটবে তারপর যদি প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আমি ক্রিটিক্যাল হবো, তাই না? লতার ঘটনায় আমরা যেটা দেখি সেখানে তো প্রশাসন দুই দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে৷ তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে৷ তদন্ত কমিটি হয়েছে৷ এটা তো প্রমাণিত যে, সে মিথ্যা বলেছে৷ তখন বলেছিল বউ ছিল পিছনে, এখন তো দেখা যাচ্ছে তার পিছনে আসলে কেউ ছিল না৷ আমার মনে হয় ওভারক্রিটিক্যাল হওয়ার চেয়ে আমাদের একটু ধৈর্যশীল হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে৷ আমরা অনেক কিছুই ওভারকাম করেছি৷ বঙ্গবন্ধু সব সময় ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলেছেন৷ ওনার কাছে মানুষই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷