গলছে বরফ
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২গলে যাচ্ছে মেরুর বরফ৷ তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে এই বিশ্বের৷ যাকে বলে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ'৷ এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের মাথাব্যাথা এই পরিবেশের উষ্ণায়ন৷ যে উষ্ণায়নের কারণে যাবতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ কোথাও খরা, কোথাও অতিবৃষ্টি৷ কোথাও বন কেটে বসত গড়ার কারণে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি৷ কোথাও দেখা যাচ্ছে মানুষের লোভ প্রকৃতিকে এমনভাবে ধ্বংস করেছে, যে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে পাগলের মত আচরণ করছে৷ আর এসবের ওপরে সবচেয়ে বেশি যে দুশ্চিন্তার বিষয়, সেই কার্বন দূষণের ব্যাপারটা তো রয়েইছে৷ বিশ্বজুড়ে শিল্প যে মাত্রায় তার ডালপালা ছড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতিতে ভয়াবহ মাত্রায় কার্বন দূষণ ঘটে চলেছে নিত্যনিয়ত৷ তাকে কমানোর জন্য বিশ্ব নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তাতে কান পাততে রাজি নয় শিল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ একেবারে শিয়রে সংক্রান্তি৷ তাই ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা নয়, কিংবা উত্তর কোরিয়া বা ইরানের পরমাণু বোমাও নয়, সমস্যাটা আসলে কিন্তু পরিবেশকে নিয়ে৷ তাকে বাঁচানোটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকারি কাজ৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের হাজার হুঁশিয়ারি থাকলেও তাতে কান দেবেটা কে?
কান দেবার জন্য এখন মাথা যদি না ঘামানো হয়, তাহলে পরবর্তীতে এমন দেরি হয়ে যাবে যে আর সময় থাকবে না৷ একথাও তো বলছেন বিশেষজ্ঞরাই৷ সেইসঙ্গে প্রতিদিন নতুন নতুন গবেষণাও তাঁরা চালিয়ে চলেছেন বিশ্বজুড়ে৷ যাতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মানুষের চেষ্টার কোথাও কোনরকমের ত্রুটি না থেকে যায়৷
সেই চেষ্টারই একটা অঙ্গ হল মেরু অঞ্চলের ভয়াবহ ঠাণ্ডায় বরফের নীচে সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা আর গবেষণা৷ মাপজোক৷ তাপমাত্রার হেরফেরের হিসাব রাখা, প্রাকৃতিক উতর চড়াইয়ের কারণ কিংবা ব্যাখ্যা জেনে নেওয়া৷ আর তার থেকেই ভবিষ্যতে পরিবেশের গতি কোনদিকে যাবে বা যেতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া৷
মেরু অঞ্চলে সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের গবেষণার কাজটি করে থাকে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দল৷ ব্রিটেনের ‘ডিফেন্স সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাবরেটরি' বা সংক্ষেপে ডিএসটিএল সেদেশের ‘ন্যাচারাল এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ কাউন্সিল' বা এনইআরসি এবং ‘ইউকে হাইড্রোগ্রাফিক অফিস' বা ইউকেএইচও-র সঙ্গে মিলে যে কাজটি করে থাকে, তাতে সারা বছর ধরে মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর, জলের উষ্ণতার ওঠানামা এবং তার পাশাপাশি এমন সব তথ্য জানা যায় যাকে ভিত্তি করে পরবর্তীতে পরিবেশের পরিবর্তনগুলির একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷
বিগত ২০১১ সালের এই সারা বছরের গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি পাওয়া গিয়েছে এ বিষয়ে৷ জানা গিয়েছে বেশ কিছু দরকারি তথ্য৷ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাদাম্পটনের ‘ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টার' বা এনওসি-র এক বৈজ্ঞানিক জন অ্যালেন জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজগুলি থেকে মেরু এলাকার পরিবেশ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে কিছু বিষয় খোলাখুলি বলা যাবেনা৷ তার কারণ, সেক্ষেত্রে সাবমেরিনগুলি কোন কোন এলাকায় গিয়েছিল, তা সকলে জেনে যেতে পারে৷ প্রতিরক্ষা আইনে সে বিষয়ে নিষেধ রয়েছে৷ তবে অ্যালান একথা জানিয়েছেন, মেরু এলাকার কোন কোন জায়গায় তাঁদের গবেষণার ফলে এমন কিছু দরকারি তথ্য মিলেছে, যাকিনা ভবিষ্যতের পরিবেশ গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
সেই বিশেষ প্রাপ্ত তথ্য বিষয়ে ডিএসটিএলের এক বিজ্ঞানী, নাম যাঁর টিম ক্লার্ক, তিনি জানাচ্ছেন, গত বছরে মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর রেকর্ড পরিমাণ নেমে গিয়েছিল৷ স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি সে বিষয়ে প্রথম হুঁশিয়ারি শোনায়৷ পরে সাবমেরিন গবেষণাতে তা ভালো ভাবে প্রমাণ হয়েছে৷ টিম জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডুবোজাহাজ গবেষণার প্রযুক্তি এমনভাবে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যাতে মেরু অঞ্চলের বরফের স্তরের ভবিষ্যৎ দিব্যি বোঝা যাচ্ছে৷ যেমন আগামী গ্রীষ্মে মেরুর বরফ অনেকটাই গলে যাবে যে, সে বিষয়ে গবেষকরা এখন নিশ্চিত৷ জানা গেছে, সে সময়ে মেরুর জল দেখা যাবে একেবারে স্বচ্ছ চেহারায়৷ পরিবেশের জন্য যা খুব একটা সুখবর নয়৷
ডুবোজাহাজের সাহায্যে মেরুর পরিবেশের এই গবেষণা ব্রিটেন চালিয়ে আসছে বহুদিন৷ কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকেই এ বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে৷ কারণ ডুবোজাহাজগুলি বরফের তলা দিয়ে কোন কোন দেশে যায় বা কোথা থেকে কী ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে, তা জানাতে আপত্তি ছিল ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের৷ সাম্প্রতিক সময়ে সেই গোপনীয়তা বজায় রেখেই গবেষণালব্ধ তথ্য জানানোর বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরিবেশ গবেষণাই উপকৃত হবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ মহল৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন