সাদা-কালো
২৬ নভেম্বর ২০১৫বাংলা অভিধান ঘেঁটে দেখলাম, ‘কৃষ্ণ' দিয়ে শুরু, এমন শব্দের সংখ্যা ২৯ আর ‘শ্বেত' দিয়ে শুরু, এমন শব্দের সংখ্যা ৩৩, কাজেই পক্ষপাতিত্বটা বাংলা ভাষা অন্তত করেনি৷ সেটা করেছি আমরা বাঙালিরা৷ এখনও পুরনো বই-তে আঙুরবালা ইত্যাদি পুরনো অভিনেত্রী, গায়িকা ইত্যাদির ফটোতে দেখবেন, জাত হিসেবে আমরা কালো বই ধলা নই৷
এমনকি দেখতেও নই৷ যেমন আমার গিন্নি, যিনি ন্যক্কারজনক রকম ফর্সা৷ বিয়ের পর প্রথম প্রথম যখন কলকাতায় যেতাম, তখন সাদা-কালো ছবিতে আমাদের দু'জনের সঠিক অ্যাপার্চার খুঁজে পাওয়া যেতো না৷ আমাকে ঠিক দেখালে, গিন্নি ওভারএক্সপোজড, যেন সাদা শাঁকচুন্নি৷ আবার গিন্নির এক্সপোজার ঠিক থাকলে, আমি আন্ডারএক্সপোজড, যেন অবন ঠাকুরের কারিয়া পিরেত৷
এতো গেল গাত্রবর্ণ৷ তারপরে আসে মুখশ্রী, মুখাবয়, ললাট, শ্মশ্রু, গ্রীবা৷ রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রথম খণ্ড কলকাতা থেকে পাঠিয়েছিলেন মা৷ রঘুপতির ভূমিকায় রবি ঠাকুরের ছবি দেখে গিন্নী বললেন: ‘বাঙালি-ফাঙালি চিনি না৷ তবে ইনি যদি বাঙালি হন, তবে তুমি বাঙালি নও৷ আর তুমি যদি বাঙালি হও, তাহলে ইনি বাঙালি নন৷' বুঝুন একবার!
গিন্নি আর আমার সৎমেয়ে, তারা হল গে ককেশীয় খোড়োচুল ব্লন্দিনী৷ ছোটমেয়ে যেন না এদেশ, না ওদেশ হয়ে তৃতীয় কোনো একটা দেশ৷ আমি নিছক দেশি৷ আমি আর গিন্নি গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে রিকশায় চড়ে ফিরতাম: লোকজন দেখতো যেন কোনো আর্মানি মা দুগগা মহিষাসুরকে নিয়ে পুজোর বাজার করে ফিরছেন৷
রং বস্তুত মানুষের চোখে৷ তাই গিন্নি আর সৎমেয়ে কতো সব মেয়ে দেখে হামলে উঠতেন: ও মা কী সুন্দর! ও মা কী সুন্দর! আমি বলতুম: সুন্দর কোথায়? ও তো বেশ কালো৷ – বেচারিরা বুঝতেই পারত না৷ পরে একদিন গিন্নি আমার কানে কানে বললেন: ব্যাপারটা কী জানো? আমাদের চোখে তোমরা সবাই কালো৷ ঐ যে, ওদেশে তোমাকে যখন জিগ্যেস করি, যে ভদ্রমহিলার কথা বলছ, যার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে, তাঁর চুলের রংটা কী? চোখের রং? তুমি তো বলতেই পারো না৷ বলবে কী করে? তোমাদের দেশে সবার চুল কালো, সবার চোখ বাদামি, ফারাক যা কিছু ঐ গায়ের রঙে৷ তাই তোমরা গায়ের রং দেখো৷
গিন্নি কিছুটা থামলেন৷ তারপর লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন: আসলে কী জানো? আমাদের চোখে তোমরা সবাই কালো৷
আমি তো যাকে বলে কিনা স্তম্ভিত৷ তোতলাতে তোতলাতে বললাম: সবাই? এমনকি আমাদের রাঙাপিসিমা, ললিত মামার বউ, খুদিপিসির বড়নাতির গার্লফ্রেন্ড, যে সাবানের বিজ্ঞাপনে নামে – সবাই কালো?
কালো মানে? গিন্নী রীতিমতো চটে গেলেন৷ আমরা যে প্রতিবছর ইটালি, স্পেন, হল্যান্ডে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে ভাজা ভাজা হয়ে একটু বাদামি হবার চেষ্টা করি, তার বেলা? ওরকম ছুটি কাটাতে কতো খরচা হয় জানো? সে রং আবার হপ্তা দুয়েক পরেই উপে যায়, আমরা আবার পাথরচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাই৷
গিন্নী আর সৎমেয়ের যাকে সবচেয়ে সুন্দরী বলে মনে হয়েছিল, সে ছিল আবার আমাদের বাড়ির সীতা নামের এক ঝি৷ বছর আঠেরোর যাকে বলে কিনা সোমত্ত মেয়ে – বড়ঘরের হলে নিশ্চয় বলতাম, দারুণ ফিগার! ঝাড়া হাত-পা, কাজ-করে-খেটে-খাওয়া ছিমছাম চেহারা, ছিমছাম সাজগোছ, কপালের মাঝখানে এক ধ্যাবড়া টিপ ছাড়া৷ ওদিকে বালিগঞ্জ স্টেশনের কয়লার ইঞ্জিনের খালাসীদের মতো কালো৷ সেদিন সন্ধ্যায় গিন্নীকে বলতে শুনলাম: তুমি এইরকম একটা মেয়ে বিয়ে করলে পারতে না?
যার উত্তর হল: না, কেননা আমরা বর্ণবাদী৷ সাধে কি আর খোদ রবি ঠাকুর ন্যাকামি করে লিখেছেন, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি; কালো মেয়ের মুখ দিয়ে শরৎবাবুকে অনুরোধ করেছেন, কালো মেয়েদের নিয়ে একটা গপ্পো লিখতে...৷
আপনার কী কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷