মুজিব হত্যার প্রতিবাদ
১৫ আগস্ট ২০১৩সেই প্রতিবাদ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে৷
সাংবাদিক অজয় দাসগুপ্ত ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্র ছিলেন৷ থাকতেন জগন্নাথ হলে৷ ছাত্র ইউনয়িন করতেন৷ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের জোট সংগ্রামী ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ১৫ই আগস্ট সকালেই তাঁরা রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পান৷ এই খবরে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন৷
তিনি জানান, তাঁরা ছাত্র নেতারা ঐ দিনই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদের চেষ্টা করেন৷ কিন্তু সেনা সদস্যদের কড়া টহলের কারণে ব্যর্থ হন৷ এরপরই ঈদ ও পূজা মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ ১৮ই অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় আবার খোলে৷ কিন্তু আগের রাতেই তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, কার্জন হলসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পোস্টার ও দেয়াল লিখনে ভরিয়ে দেন৷ দেয়াল লিখনের ভাষা ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু', ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে'৷ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ব্যানারে এভাবেই ঢাকায় প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানান হয়৷
অজয় দাসগুপ্ত জানান, এরপর ২০শে অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়৷ সমাবেশ শেষে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন ছাত্ররা৷ ২১শে অক্টোবর আবার প্রতিবাদ সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ হামলা চালায়৷ এরপর ২৯শে অক্টোবর আবার সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হলে ক্যাম্পাসে সেনা সদস্যরা টহল দেয়া শুরু করে৷ ফলে তাঁরা ২৯শে অক্টোবর আর প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারেননি৷ কিন্তু ওই সময়ে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসরুমে ছাত্রদের মধ্যে গণসংযোগ চালিয়েছেন৷ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবিতে ছাত্রদের সংগঠিত করেছেন৷
অজয় দাস গুপ্ত আরও জানান এরপর ৪ঠা নভেম্বর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্র প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়৷ সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্য যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য গায়েবানা জানাজা পড়া হয়৷ করা হয় প্রতিবাদ সমাবেশ৷ তিনি জানান, তাঁরা মিছিল করে যাওয়ার সময় রাস্তায় সেনা সদস্য এবং ট্যাংকের টহল দেখতে পান৷ ফিরে আসার পথে জানতে পারেন, আগের দিন, অর্থাৎ ৩রা নভেম্বর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে৷ এই খবরে বিক্ষোভ আর শোকে ফেটে পড়েন ছাত্ররা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে মধুর ক্যান্টিনে আবারো সমাবেশ করে৷ বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ৫ই নভেম্বর ঢাকায় আধা বেলা হরতালের ডাক দেয়া হয়৷ ৫ই নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল শেষে ছাত্ররা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে গিয়ে গায়েবানা জানাজা পড়েন৷ পরের দিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ হয়৷ কিন্তু ৭ই নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান এবং সেনাশাসন চলে আসায় মুজিব হত্যার প্রতিবাদের প্রথম পর্যায়ের সেখানেই সমাপ্তি ঘটে৷
অজয় দাসগুপ্ত জানান, ১৫ই আগস্টে ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, খুলনা এবং বরগুনাসহ ঢাকার বাইরে আরো কয়েকটি এলাকায় প্রতিবাদ হলেও ঢাকায় প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ হয়েছিল ২০শে অক্টোবর৷ আর সে প্রতিবাদ করেছিলেন ছাত্ররা৷ তখন ছাপানো হয়েছিল প্রতিবাদী লিফলেট৷ এই লিফলেট পুরো ঢাকা শহরে ছড়ানো হয়েছিল৷ লিফলেট বিতরণ গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছিলেন৷
তিনি বলেন, মুজিব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে তখন সক্রিয় ছিলেন সে সময়ের ছাত্র নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূর-উল-আলম লেনিন, কাজী আকরাম হোসেন, মাহবুব জামান, বাহলুল মজনুন চুন্নু, মৃণাল সরকার, রবিউল আলম মুক্তাদির, ইসমত কাদির গামা, খন্দকার শওকত হোসেন, মমতাজ হোসেন, কাজল ব্যানার্জি প্রমুখ৷
অজয় দাসগুপ্ত জানান, ১৫ই আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আসার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের৷ তাঁর কর্মসূচির মধ্যে একটি ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা৷ কিন্তু সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা জানলেন তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা৷