মুখ্যসচিবকে নিয়ে মোদী-মমতা লড়াই
৩১ মে ২০২১ঘূর্ণিঝড়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কলাইকুন্ডায় সেই বৈঠকে ডাকা হয়েছিল রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীকে। কিন্তু শুভেন্দুকে ডাকা হয়েছে দেখে বেঁকে বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় তার ডানহাত বলে পরিচিত শুভেন্দু ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন এবং নন্দীগ্রামে তিনি মমতাকে ভোটে হারিয়েছিলেন। মমতার প্রশ্ন ছিল, সরকারি এই বৈঠকে শুভেন্দুকে কেন ডাকা হলো?
সেই বৈঠকে মমতা ঢুকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়ে চলে গিয়েছিলেন দিঘার পরিস্থিতি দেখতে। সঙ্গে করে তিনি আলাপনকেও নিয়ে গেছিলেন। একজন আমলা এই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠক থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দেয়, আলাপনকে দিল্লিতে বদলি করা হলো। তাকে সোমবার বেলা দশটায় দিল্লিতে কাজে যোগ দিতে হবে। কোন পদে তা চিঠিতে বলা হয়নি।
ঘটনা হলো, সোমবারই ছিল আলাপনের কাজের শেষ দিন। কিন্তু করোনা ও ঘূর্ণঝড়ের পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কাছে অনুরোধ করেন, তার কাজের মেয়াদ তিন মাস বাড়িয়ে দেয়া হোক। কেন্দ্র তা মেনে নেয়। কিন্তু তারপর এই বিরোধের জেরে তাকে দিল্লিতে বদলি করে দেয়া হয়। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীকে। সেখানে তিনি বলেন, করোনা ও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজ্যে আলাপনকে দরকার। তাই তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া নিয়মানুযায়ী, রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলে, মুখ্যসচিবকে বদলি করা যায় না। কেন্দ্র নিয়ম ভেঙেছে। আর করোনা ও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতিতে মুখ্যসচিবকে এইভাবে বদলি করা মানে রাজ্যের মানুষকে শাস্তি দেয়া। এটা পশ্চিমবঙ্গকে অপমান করা।
কেন্দ্রীয় সরকারেরর নির্দেশ মেনে সোমবার আলাপন দিল্লি গিয়ে কাজে যোগ দেননি। আলাপন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইএএস অফিসার। এটা কেন্দ্রীয় সার্ভিস। আলাপনকে বদলির নির্দেশে বলা হয়েছিল, নিয়মানুসারে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে এক্ষেত্রে কোনো বিরোধ হলে কেন্দ্রের নির্দেশ বহাল থাকবে।
এরপরই মুখ্যসচিব-বিতর্ককে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনীতি। বিজেপি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বলছেন, এটা প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে। যা একজন আমলা করতে পারেন না। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের বক্তব্য. মুখ্যসচিব বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করেছেন। তার মতে, ''প্রধানমন্ত্রী বৈঠক ডেকেছেন। তাতে মুখ্যসচিবকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বৈঠক ছেড়ে চলে গেলেন। এটা কী করে করা সম্ভব? এটা কোনোভাবে তিনি করতে পারেন না।''
এর জবাবে রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছেন, ''মুখ্যসচিব ওয়াকআউট কোথায় করলেন? মুখ্যসচিব রাজ্য সরকারের অধীনে কাজ করেন। মুখ্যমন্ত্রী তাকে নিয়ে গেছিলেন এবং সঙ্গে নিয়ে চলে গেছিলেন।'' চন্দ্রিমার অভিযোগ, ''মুখ্যমন্ত্রীকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাইরে বসে থাকতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাদের সঙ্গে বসে ছিলেন। তা কাম্য নয়। তার দাবি, বিজেপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে।''
সাবেক আইএএস অফিসারদের অনেকেই আলাপনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাবেক কেন্দ্রীয় সচিব জহর সরকার মনে করেন, ''দেশে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে। রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলে কেন্দ্র এই কাজ করতে পারে না। রাগ পোষণ করে উল্টোপাল্টা অর্ডার শোভনীয় নয়।''
আরেক সাবেক আইএএস অর্ধেন্দু সেন এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি লিখেছেন, তাতে বিষয়টি বোঝানো আছে যে, কেন আলাপনকে ছাড়া উচিত হবে না। করোনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য।'' তিনি বলেছেন, ''মতবিরোধ মিটে যাবে বলে আশা করছি। মুখ্যসচিবের তরফে কোনো ভুল হলে সেটা দেখার সময় আছে।''
সাবেক কেন্দ্রীয় সচিব অনীতা অগ্নিহোত্রীও এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পরিশীলিত। তাতে রুলসের রেফারেন্স আছে। বলা হয়েছে, এটা টেকনিক্যালি ভুল সিদ্ধান্ত।''
আলাপন কি প্রটোকল ভেঙেছেন? এনিয়েও দ্বিমত আছে। প্রোটোকল হলো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সরকারি পোশাক অর্থাৎ, বন্ধগলা পরতে হয়। কিন্তু আলাপন তা পরেননি। সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের যুক্তি হলো, কলাইকুন্ডা হলো বিমানবাহিনীর বিমানবন্দর। সেখানে সরকারি পোশাক গলাবন্ধ পরা জরুরি নয়। আর যেহেতু তিনি রাজ্য সরকারের অধীনে, তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মানতে বাধ্য। সে জন্য তিনি চলে গেছিলেন।
ঘটনা হলো, রাজ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলাকে সামনে রেখে মোদী-মমতার যুদ্ধ চলছে। মমতা বলে রেখেছেন, কেন্দ্র আলাপনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে আদালতে যাবে রাজ্য। সেক্ষেত্রে এই লড়াইয়ে শেষ কথা বলবে আদালত।
জিএইচ/এসজি(পিটিআই, এএনআই, আনন্দবাজার)