মা হারা শিশুদের মাতৃদুগ্ধ দিতে নেটওয়ার্ক তৈরি কলকাতায়
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১সমাধানে তথ্যপঞ্জী গড়তে উদ্যোগী দুই তরুণী৷ মহাশ্বেতা দেবীর 'স্তনদায়িনী' গল্পে যশোদা জমিদারবাড়ির শিশুদের নিজের বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন৷
এককালে এভাবেই অসহায় শিশুদের মাতৃদুগ্ধের যোগান দিতে হাজির হতেন দুধ-মায়েরা৷ কোভিড পরিস্থিতি বিভিন্ন বিষয়ের মতো স্তন্যপানের ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব সঙ্কট তৈরি করেছে৷ সদ্যোজাত শিশুকে রেখে মারা গিয়েছেন অনেক নারী৷ এছাড়া অনেক শিশুর মা কোভিডের জন্য কোয়ারান্টিনে রয়েছেন৷ তার ফলে শিশুদের থেকে জন্মদাত্রীকে দীর্ঘসময় দূরে থাকতে হচ্ছে৷
অথচ এই মা-হারা বা মায়ের থেকে দূরে থাকা শিশুদের প্রধান খাদ্যই হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ৷ তার ফলে কি এই প্রজন্মের একটা অংশ মাতৃদুগ্ধের অভাবে ভবিষ্যতে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হবে? এই প্রশ্নটা ভাবিয়ে তুলেছিল বৈদেহী দাস ও মণিময়ী চক্রবর্তীকে৷ নবজাতকেরা যাতে মাতৃদুগ্ধে বঞ্চিত না হয় , সেই লক্ষ্যে তথ্যপঞ্জী গড়ছেন এই দুই তরুণী, যার পোশাকি নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্রেস্ট মিল্ক রিসোর্স নেটওয়ার্ক'৷ কেন এমন উদ্যোগ? মণিময়ী বলেন, ‘‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অক্সিজেন রিসোর্স খুঁজতে সাহায্য করতাম৷ কিন্তু তারপর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের একটা পোস্ট দেখি৷ দিল্লিতে মাতৃদুগ্ধ খুঁজছে৷ তারপরই আমাদেরও মনে হয় কলকাতায় এমন হবে না কেন?'' প্রথমদিকে এই দুই তরুণীও অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু এ রকম কিছু কলকাতায় নেই৷ এমনকি মিল্ক ব্যাঙ্ক নিয়ে বিশেষ সচেতনতাও গড়ে ওঠেনি৷ কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালেই একমাত্র মিল্ক ব্যাঙ্ক রয়েছে৷ তাও হাসপাতালে ভর্তি শিশুরাই এই ব্যাঙ্কের সুবিধা পায়৷ এই পরিস্থিতিতে এই দুই তরুণী শিশুদের সঙ্গে দুধ ডোনার মায়েদের সংযুক্ত করতেই গড়ে তোলেন এই রিসোর্স নেটওয়ার্ক৷
বৈদেহী বলেন, ‘‘আসামেও এমন একজন মহিলার খবর পেয়েছিলাম যিনি নিজের ব্রেস্ট মিল্ক দান করতে চান৷ তারপরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, একটি বাচ্চার মা মারা গিয়েছে, তার মাতৃদুগ্ধ লাগবে৷ ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, এটা বরাবরের সমস্যা৷ তাই এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাটা জরুরি ছিল৷'' চিকিৎসকরা এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন৷ তবে দুধ শিশুকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা নিতে
হয়৷ শিশুমঙ্গল হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অর্ণব রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মায়েদের সাজেস্ট করি, বুকের দুধ বের করে সাধারণ তাপমাত্রায় আট ঘন্টা অবধি রেখে দিলে ভাল থাকে৷ ফ্রিজে রাখলে ২৪ ঘণ্টা অবধি থাকতে পারে৷ এটা নিশ্চিত করতে হবে, মহিলাদের থেকে শিশুর শরীরে কোনো রোগের ট্রান্সমিশন যেন না হয়৷''
মাতৃদুগ্ধ দানে আগ্রহী মায়ের তথ্যপঞ্জী তৈরি করা দুই ছাত্রীর পক্ষে মোটেই সহজ কাজ নয়৷ রয়েছে সামাজিক বাধা৷ সেটা অতিক্রম করে ডোনার মায়েরা দুধ দানে এগিয়ে এসেছেন৷ তবু তথ্যপঞ্জিতে এখনো পর্যন্ত যুক্ত ১৭ জন মায়ের নাম গোপন রাখা হচ্ছে৷ সতর্কতা হিসেবে মহিলাদের তিন মাস অন্তর অন্তর এইচআইভি বা হেপাটাইটিস টেস্ট করানো হয় চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে৷ এক্ষেত্রে সেতুর ভূমিকা নেওয়া মণিময়ী বলেন, ‘‘যাঁরা সদ্যোজাত শিশুদের দুধের জন্য আমাদের কাছে আসছেন, তাঁদের সঙ্গে দুগ্ধদানে আগ্রহী মায়েদের যোগাযোগটাই করিয়ে দিচ্ছি৷ তারপর ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে সকলে এগোচ্ছেন৷'' অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, দুগ্ধদান করার পরে স্তনদাত্রী মায়েদের সন্তানরা দুধ থেকে বঞ্চিত হবে না তো? সংশয় দূর করে ডা. রায় বলেন, ‘‘এটা চাহিদা ও যোগানের অনুপাত৷ কোনো মা নিয়মিত হারে যদি অন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান, তাহলে সেই চাহিদা বুঝে শরীর বেশি দুধই উৎপন্ন করবে৷'' এ দেশে মায়ের দুধ বিক্রিও হয়৷
এ বিষয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস-এর প্রাক্তন সভাপতি ডা. অর্জুন মাঙ্গলিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ দেশে হিউম্যান মিল্কের প্রচুর দাম৷ সাধারণের পক্ষে সেটা কেনা সম্ভব নয়৷ তাই আরো মিল্ক ব্যাঙ্ক হওয়া উচিত ছিল৷ বিষয়টা কেউ ভেবেই দেখেনি৷ প্রাইভেট সেক্টরে টেস্টিং বা পাস্তুরাইজেশনে অনেক খরচ৷ তাই নিয়ম ও সুরক্ষাবিধি মেনে এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত৷'' বৈদেহী, মণিময়ীরা তথ্যপঞ্জি তৈরির সময় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন নতুন মায়েদের৷ তাঁরা বলেন, ‘‘ডাক্তারদের উপদেশ মেনেই যাঁরা নতুন মা হয়েছেন, তাঁদেরই ডোনার হিসেবে রাখছি৷ মেডিকেল হিস্ট্রিও নিয়ে রাখি৷ অনেকেই আসেন, তবে এলিজিবল সবাই হন না৷'' অতিমারির পরিস্থিতিতে শিশুর কাছে দুধ দানে আগ্রহী মহিলার পৌঁছে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে৷ যাতে উভয়ের বাসস্থল কাছাকাছি হয়, সেটাও মাথায় রাখা হচ্ছে৷