মানুষগুলো অসহায়, পাশে থাকুন
৩ নভেম্বর ২০১৫মানসিক ভারসাম্য বেশি মাত্রায় নষ্ট হলে, অর্থাৎ মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় হারিয়ে ফেললে যে কারোরই এমন অবস্থা হতে পারে৷ এক উচ্চ শিক্ষিত ভদ্রলোকের কথা জানি৷ অবসর জীবনে তিনি হঠাৎই সমাজের চোখে ‘পাগল' হয়ে যান৷ প্রথম প্রথম ঘরের বাইরে কোথাও একা বসে থাকতেন৷ একা একাই কী সব ভাবতেন৷ ষাটোর্ধ্ব ওই ভদ্রলোক বাইরে বাইরে থাকেন বলে নিজের বাড়িতেই শুরু হলো তাঁর ব্যাপক সমালোচনা৷ ছোট-বড় সকলেই তীর্যক কথার বাণে ঘায়েল করলেন তাঁকে৷ ঘায়েল হয়ে তিনি ঘরকে আরো ‘পর' করলেন৷ রাস্তায় রাস্তায়ই থাকতেন৷ ‘পাগল' বললে বাচ্চাদের তাড়া করতেন, কোনো বড় মানুষের হাসিমুখ নাগালে পেলে কষে চড় মেরে মনের ঝাল মেটাতেন৷
ছিলেন সরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা৷ অথচ তখন যেন তিনি এক বখাটে কিশোর৷ যে কেউ তাঁকে যেভাবে খুশি ‘শাসন', ‘শায়েস্তা' করে৷ নালিশ আসতে থাকে বাড়িতে৷ অল্প দিনেই বাড়ির সবাই অতিষ্ট৷ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটিকে বেঁধে গৃহবন্দি করে পরিবারের ‘মান-সম্মান' বাঁচাতে হবে৷ পরিবারের ‘মান-সম্মান'-এর কথা সবাই ভেবেছিলেন কিন্তু ওই ভদ্রলোককে সত্যিকার অর্থে বাঁচানোর চেষ্টা কেউ করেননি৷ মানসিক রোগের চিকিৎসা করালে হয়তো আবার সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতেন৷ সামান্য জ্বর হলেও ডাক্তার ডাকা হতো, কিন্তু মনে যে তাঁর ‘ক্যানসার', সেই ব্যাধির চিকিৎসার কথা কেউ ভাবেইনি! ‘সুদিনের স্বজনদের' বেশিদিন তিনি কষ্ট দেননি৷ সবার ‘সম্মান' অটুট রেখে, সবার জীবনে ‘শান্তি' ফিরিয়ে দিয়ে একদিন অতি নীরবে চিরপ্রস্থান হয় তাঁর৷
মনের অসুখে পর্যুদস্ত মানুষগুলো বড় একা৷ শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে, তারুণ্যে কি বার্ধক্যে- যে যখন মনোজগতে ঝড়ের মুখোমুখি সে-ই একা৷ ঘরে একা, বাইরেও একা৷
কার হয়না মনের অসুখ? ছেলে-বুড়ো সবার হয়৷ তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও হয়৷ প্রথমে হয়তো একটু বিষন্নতায় পেলো, আদর-যত্ন-চিকিৎসার অভাবে তা-ই হয়তো একসময় সবার চোখে ধরা দিল ‘পাগলামি' হিসেবে৷
সহানুভূতিশীল সচেতন স্বজনের বড় অভাব তাঁদের৷ বন্ধুর অভাব, চিকিৎসকের অভাব, হাসপাতালেরও অভাব৷ এসব আমরা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে তো জানিই, সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে আরো ভালো করে জানি৷
অনেকেই জানি, মনরোগে ভালোবাসা আর চিকিৎসাটা জরুরি৷ বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের ১৮ শতাংশই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত৷
যে দেশে শিশুদেরই এমন অবস্থা, সে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মনরোগী যে অনেক বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য৷ দেশে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আছে মাত্র ১১টি৷ ১৬ কোটি মানুষের দেশে মনরোগ বিশেষজ্ঞ মাত্র ২০০ জন! প্রয়োজনের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খুব কম৷ রোগী এবং রোগীর আত্মীয়দের সচেতনতার অভাবে এ রোগের চিকিৎসা করানোর প্রবণতা তার আরো কম৷
আত্মকেন্দ্রিকতার এ যুগে সমস্যাসংকুল কোনো দেশের মানুষ এমনিতেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক নানাবিধ চাপের বিপরীতে সদা অসহায়৷ মনরোগে আক্রান্তদের অসহায়ত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি প্রকট, অনেক বেশি অসহনীয়৷ শিশুদের মতো মনরোগীদেরও সচেতন সহানুভূতিশীল আন্তরিক স্বজন বড় বেশি প্রয়োজন!
যে কোনো মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন৷ আপনার চেনা মানুষদের মধ্যে কেউ কি কখনও মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন? জানেন সেই গল্প, নীচের মন্তব্যের ঘরে৷